বাংলা রচনা : শিশু ও নারী পাচার

শিশু-ও-নারী-পাচার

শিশু-ও-নারী-পাচার

[ সংকেত : ভূমিকা; শিশু ও নারী পাচারের পটভূমি; পাচারকারী চক্র; পাচার প্রতিরােধে ব্যর্থতা; শিশু ও নারী পাচারে আইন ও  শাস্তি; পাচার প্রতিরােধে সচেতনতা; উপসংহার। ]

ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বেও নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে আজও এই বৈষম্য নিরসন হয়নি। বরং সভ্যতার চরম উৎকর্ষ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন সত্ত্বেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত শিশু ও নারী পাচারের মতাে জঘন্য ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে অনুন্নত দেশ অথবা উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের বিষয় যেন অনেকটা গা সওয়া ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পাচারের পর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা বেড়ে চলেছে। অথচ এই ভয়ানক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রবল কোনাে প্রতিরােধ এখনও গড়ে ওঠেনি। তাই তাে বিশ্বব্যাপী শিশু ও নারী পাচারে জড়িত রয়েছে নানা ধরনের চক্র।

শিশু ও নারী পাচারের পটভূমি : শিশু ও নারী পাচারে এখন একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষণে পাওয়া যায় যে, ভারতের মুম্বাই, হায়দারাবাদ ও কলকাতা ভিত্তিক মানব পাচার চক্রগুলাে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলাের মধ্যে বাংলাদেশ শিশু ও নারী পাচারের অন্যতম উৎসস্থল। হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবেশী অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে পাচারের প্রয়ােজনে বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণত দারিদ্র-পীড়িত এবং সামাজিকভাবে অসচেতন পরিবারের নারী ও শিশু এই চক্রের মােক্ষম শিকারে পরিণত হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে উচ্চ বেতনের কোনাে চাকরি কিংবা আরাম-আয়েশের জীবন; শিশুদের পরিবারের কোনাে নিকট আত্মীয়ের যােগসাজশ, উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি— এসব পাচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এ পাচারের শিকার অধিকাংশ নারীর স্থান হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন যৌন পল্লিতে। এছাড়াও জনশক্তি রপ্তানির নামে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সরকারের কোনাে নিয়ম-নীতি তােয়াক্কা না করেই অধিক অর্থ আদায় করে জাল কাগজপত্র তৈরি করে বিদেশে পাঠায়; ফলে ভাগ্যাহতদের ওপর নেমে আসে নানা ধরনের যৌন নির্যাতন। অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী ও শিশু পাচার প্রতিরােধের ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রস্তুতি নেই। উপরন্তু কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালাল চক্র এ ধরনের হীন কাজের সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, তালাকের অবাধ সুযােগ, প্রেমে প্রতারণা, কুসংস্কার, দাম্পত্য কলহ, মানসিক পীড়াসহ নানাবিধ কারণে নারী পাচারের মতাে ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে জানা যায় যে, নারী ও শিশু পাচারের বিনিময়ে পাচারকারীরা বিদেশ থেকে নানা ধরনের অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে। এতদ্ব্যতীত পাচারকারীরা শিশু ও নারীর দেহের চোখ, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চড়া দামে বিক্রি করে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় দশ হাজার নারী ভারত, পাকিস্তান, ওমান ও সিঙ্গাপুরসহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশে উচ্চমূল্যে পতিতালয়ে বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এ চিত্র আরও মর্মান্তিক; তাদের চড়া দামে বিক্রি করা হয় উটের জকির মালিকদের কাছে। দেশে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরােধে কয়েক হাজার মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এবং নানা জটিলতায় দৃষ্টান্তমূলক বিচার অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেও পাচারকারীরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। যদিও সরকার এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর মনােভাব পােষণ করছে। নারী-শিশু পাচারকারীকে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। তথাপি এ ভয়াবহ অপরাধের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না; সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের তথ্যানুসারে পাচারকৃত নারীদের ধনী ব্যক্তিদের রক্ষিতা, অশ্লীল ছবি তৈরিতে ব্যবহার, বাসাবাড়ি ও কল-কারখানয় লাভজনক শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার, শিশুদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার কিংবা নিঃসন্তান দম্পত্তির নিকট উচ্চ মূল্যে বিক্রি, মাদক চোরাচালানসহ নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি টেকনাফ অঞ্চলের রােহিঙ্গা শরণার্থী নারী ও শিশু এবং পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী নারীরা পাচার চক্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে দিন দিন পাচারকারী চক্র সংঘবদ্ধ হচ্ছে।

পাচারকারী চক্র : পাচারকারীরা এ সভ্য-সমাজেরই একজন হিসেবে কৌশলে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। তাই সরাসরি তাদের শনাক্ত করাও বেশ কঠিন। আর এদের মূল হােতা সচরাচর তথাকথিত বিত্তশালী এবং সম্রান্ত হওয়ায় এদের বেছে বের করাও অসম্ভব । অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা প্রশাসন কিংবা রাজনীতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের শিকড়কে মজবুত করে । এরা শক্তিশালী সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে এ ধরনের অপতৎপরতা সহজেই চালাতে পারে। গ্রামের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ও সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে এরা অল্প দিনের মধ্যেই ভাব জমিয়ে তুলতে পারে। ফলে । যেকোনাে পরিবারের সঙ্গে মামা, খালু, চাচা, ভাই ইত্যাদি সম্পর্কও গড়ে তুলে এসব পরিবারের পরম আপনজন হিসেবে নিজেদের জাহির করে। এছাড়াও বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকায় কিছু অভিজাত ফ্ল্যাটে ভদ্রবেশি মহিলারাও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। কিছু আবাসিক হােটেল মালিকও এ ধরনের কাজে লিপ্ত আছে। দেশে-বিদেশে দালালেরা মিলে একটি আন্তর্জাতিক চক্রের জন্ম দিয়েছে। পাসপাের্ট ও ইমিগ্রেশন অফিসের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এদের রয়েছে গভীর সখ্য। সাধারণত প্রতি মাসে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন নারী পাচার হয়। বিশেষ করে দুবাইয়ের দালালচক্র এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে এই পাচারের কাজে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃদেশীয় পাচারকারীচক্র এটিকে সফল বাণিজ্যে রূপ দিয়েছে। ফলে পৃথিবী জুড়ে রয়েছে পাচারকারীদের এক মজবুত ভিত্তি। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ভার থেকে কেউই মুক্ত নয়।

পাচার প্রতিরােধে ব্যর্থতা : যেকোনাে সরকারই পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কোনাে সুনির্দিষ্ট অভিযান পরিচালনা করতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনাে সরকারকে রাজনীতিক সমস্যা মােকাবিলা করতে যে পরিমাণ ব্যস্ত থাকতে হয় সেই সুযােগে এ চক্র নিজেদের আরও সংঘটিত করে। আমাদের রাজনীতিক সদিচ্ছার অভাব এক্ষেত্রে প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া যথেষ্ট সচেতনতার অভাব তাে বরাবরই রয়েছে। আর পাচারকারী চক্রকে শাস্তি প্রদানেও নানা ধরনের আইনি জটিলতা রয়েছে। মামলা প্রমাণের পিছনে রয়েছে এজাহার লেখার অদক্ষতা, সাক্ষীর অভাব এবং মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা; রয়েছে গ্রাম-গঞ্জের মাতব্বরদের উদাসীনতা, কিছু অসাধু আইনজীবীর কূটকৌশল । ফলে কার্যত এ পাচারের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিরােধ ব্যবস্থা অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি। তবে আইনি প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানাের জন্য ইতােমধ্যে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

শিশু ও নারী পাচারে আইন ও শাস্তি : জাতিসংঘের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী শিশু ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত চক্র এ ন্যাক্কারজনক কাজ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি আয় করে। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী আইনের ধারাগুলাের ব্যাপক সংস্কারের প্রয়ােজন রয়েছে। এ লক্ষ্যে নারী ও শিশু পাচারকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান আইনে রাখা হয়েছে । আইনে আরও বলা আছে যে, কোনাে ব্যক্তি কোনাে নারীকে পতিতাবৃত্তির জন্য, নির্যাতনের জন্য বা অনুরূপ কোনাে উদ্দেশ্যে তার জিম্মায় রাখলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ বছরের কারাদণ্ড ও অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও হবে । অনুরূপভাবে কোনাে ব্যক্তি কোনাে শিশুকে আমদানি, রপ্তানি বা অন্য কোনাে উদ্দেশ্যে নিজ হেফাজতে রাখলে উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে । আবার কোনাে ব্যক্তি যদি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোনাে নারী বা শিশুকে আটক রাখে তবে উক্ত ব্যক্তিও উপরিউক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু শুধু আইন করে এবং তার প্রয়ােগের মধ্য দিয়ে, এ ভয়াবহ সমস্যার শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না; এজন্য প্রয়ােজন সর্বস্তরে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা।

পাচার প্রতিরােধে সচেতনতা : শিশু ও নারী পাচার মানব সভ্যতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর। এর দ্বারা মধ্যযুগীয় বর্বরতায় সমস্ত মানবিক মূল্যবােধ আর অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। অথচ এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কোনাে সােচ্চার প্রতিবাদ গড়ে ওঠেনি। অবশ্য কিছু বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম এ ব্যাপারে অগ্রসর হয়েছে। তথাপি প্রয়ােজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। যদিও গণমাধ্যমে নানা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, ফিচার কিংবা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে শিশু ও নারী পাচার বােধে কিছু অবদান রাখছে। কিন্তু সমস্যার গভীরে পৌঁছে সমাধানের কোনাে পথই এখনও বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দণ্ড বা শাস্তি দিয়ে এ ধরনের অপরাধ থেকে অপরাধীকে নিবৃত্ত করা হয়তাে সম্ভব হবে না; কেননা এ পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে— হীন মানসিকতা, মনসব চিন্তা-চেতনা, যৌনলিপ্সা, অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতি, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি; সর্বোপরি নারী ও শিশুর প্রতি সীমাহীন বৈষম্য। তদুপরি বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এ সমস্যা বহুলাংশে নিরসন করা সম্ভব। কেননা ওষুধ দিয়ে রােগ সারানাের চেয়ে রােগ যাতে দেহে বাসা বাঁধতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা করাই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে সচেতনতাই মােক্ষম হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

উপসংহার : বিশ্বে নারী ও শিশু পাচার এক মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি প্রতিরােধে বিচ্ছিন্নভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা মােটেই ফলপ্রদ হয়নি। আন্তর্জাতিক নারী সমিতি, শিশু সংগঠনসহ সার্ক, নানা সংগঠন ও জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যম, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ শুধু তথ্য-উপাৰে মধ্যে | সীমাবদ্ধ রেখে এ ভয়াবহ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং সবস্তরের মানুষকে একই প্ল্যাটফরমে দাড়িয়ে এই পাচারের দিক যুদ্ধ ঘােষণা করতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url