মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ

মহানবি (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ

[৯ জিলহজ, শুক্রবার, হিজরি ১০ সাল; মক্কার ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে প্রদত্ত] 

মহানবি (সা.) হিজরি দশ সালে হজ পালন করেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। ইসলামের ইতিহাসে এটি বিদায় হজ হিসেবে খ্যাত। সেবার ৯ জিলহজ, শুক্রবার দুপুরের পর আরাফাত ময়দানে সমবেত লাখাে সাহাবির উদ্দেশে মহানবি (সা.) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ভাষণটি নিচে দেওয়া হলাে: 

পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার প্রশংসার পর মহানবি (সা.) ইরশাদ করেন : আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নাই । তার সমকক্ষ কেউ নেই। আল্লাহ তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। আর তিনিই বাতিল শক্তিগুলাে, পরাভূত করেছেন। হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমি তােমাদের আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর বন্দেগির ওসিয়ত এবং এর নির্দেশ দিচ্ছি। 

হে লােকসকল! 

তােমরা আমার কথা শােন। এরপর এই স্থানে তােমাদের সাথে আর একত্র হতে পারব কি না জানি না।

হে লােকসকল 

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি! তােমাদের আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে পয়দা করেছি এবং তােমাদের সমাজ ও গােত্রে ভাগ করে দিয়েছি, যেন তােমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পার। তােমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তােমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সকল বিষয়ে , আল্লাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে । ইসলামে জাতি, শ্রেণিভেদ ও বর্ণ বৈষম্য নেই। আরবের ওপর কোনাে আজমের, আজমের। ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালাের বা কালাের ওপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মর্যাদার ভিত্তি হলাে কেৱঁল তাওয়া। আল্লাহর ঘরের হেফাজত, সংরক্ষণ ও হাজিগণের পানি পান করার ব্যবস্থা পূর্বের ন্যায় এখনও বহাল থাকবে। হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লােকগণ! তােমরা দুনিয়ার বােঝা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন আল্লাহর সামনে হাজির না হও। আমি । আল্লাহর বিরুদ্ধে তােমাদের কোনাে উপকারই করতে পারব না। শুনে রাখ, সকল জাহিলি বিষয় ও প্রথা আজ আমার পায়ের নিচে।

জাহিলি যুগের রক্তের দাবি রহিত করা হলাে। সর্বপ্রথম আমি আমার কাবিলার রক্তের অর্থাৎ রবী’আ ইবনুল হারিসের পুত্রেই রক্তের দাবি রহিত ঘােষণা করছি। বনু সা’দ গােত্রে থাকাকালে হুযাইলিরা তাকে হত্যা করেছিল। জাহিলি যুগের সুদও রহিত করা হলাে। সর্বপ্রথম আমি আমার কাবিলার দাবি অর্থাৎ চাচা আব্বাসের সুদ মাফ করে দিলাম। সুতরাং সকল সুদ আজ রহিত করা হলাে। 

হে লােকসকল 

আজকের এ দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র তেমনি তােমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। তােমরা শীঘ্রই আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। তিনি তােমাদের সকলকেই তােমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জেন রাখা অপরাধীর দায়িত্ব কেবল তার ঘাড়েই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্য এবং পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়। 

হে লােকসকল 

নারীদের সম্পর্কে আমি তােমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। এদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করার সময় আল্লাহর দণ্ড সম্পর্কে নির্ভয় হয়ো না। নিশ্চয়ই তাদের তােমরা আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই বাক্যের মাধ্যমে তাদের সাথে তােমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক হয়েছে। জেনে রাখ, তাদের ওপরে যেমন তােমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তােমাদের প্রতি তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণ সাধনের বিষয়ে তােমরা আমার নসিহত গ্রহণ কর। তােমরা তােমাদের অধীন লােকদের সম্পর্কেও সতর্ক হও। নিজেরা যা খাবে, তাদেরও তা খাওয়াবে; নিজেরা যা পরবে, তাদেরও তা পরাবে। 

হে লােকসকল

শুনে রাখ, মুসলমানরা পরস্পর ভাই। সাবধান! আমার পরে তােমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতাে কুফরি কাজে লিপ্ত হয়াে না। 

হে লােকসকল 

আল্লাহ প্রত্যেককেই তার যথাযথ অধিকার দিয়েছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীর জন্য কোনােরূপ ওসিয়ত কার্যকর হবে না। সন্তান হলাে বিবাহিত দম্পত্তির। ব্যাভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই। আর সকল হিসাব-নিকাশ আল্লাহর ওপর • ন্যস্ত । যে ব্যক্তি নিজের পিতার স্থলে অপরকে পিতা বলে পরিচয় দেয়, নিজের মওলা বা অভিভাবক বলে পরিচয় দেয়, তার ওপর আল্লাহর লানত। ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। প্রত্যেক আমানত তার হকদারের নিকট অবশ্যই আদায় করে দিতে হবে । কারাে সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারাে জন্য হালাল নয়। সুতরাং তােমরা একজন অপরজনের ওপর জুলুম করবে না। এমনিভাবে কোনাে স্ত্রীর জন্য তার স্বামীর সম্পত্তির কোনাে কিছু তার সম্মতি ব্যতিরেকে কাউকে দেওয়া বৈধ নয়। যদি কোনাে নাক-কান কাটা হাবশি দাসকেও তােমাদের আমির বানিয়ে দেওয়া হয় তবে সে যতদিন আল্লাহর কিতাব অনুসারে তােমাদেরকে পরিচালিত করবে, ততদিন অবশ্যই তার কথা মানবে, তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। 

শােন, তােমরা তােমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যথারীতি আদায় করবে, রমযানে রােযা পালন করবে, স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে তােমাদের সম্পদের যাকাত দেবে, তােমাদের রবের ঘর বায়াতুল্লাহর হজ পালন করবে আর আমিরের ইতাআত করবে; তাহলে তােমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে। 

হে লােকসকল! 

আমার পর আর কোনাে নবি নেই, আর তােমাদের পর আর কোনাে উন্মতও নেই। আমি তােমাদের নিকট দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন তােমরা এ দুটোকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তােমরা গুমরাহ হবে না। সে দুটো হলাে আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাত। তােমরা দিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে; কেননা তােমাদের পূর্ববর্তীরা দিনের ব্যাপারে এই বাড়াবাড়ির দরুন ধ্বংস হয়েছে। এই ভূমিতে আবার শয়তানের পূজা হবে। এ বিষয়ে শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তােমরা তার অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এতে সে সন্তুষ্ট হবে। সুতরাং তােমাদের দিনের বিষয়ে শয়তান থেকে সাবধান থেকো। 

শােন, তােমরা যারা উপস্থিত আছ, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে আমার পয়গাম পৌছে দিও। অনেক সময় দেখা যায়, যার কাছে পৌছানাে হয় সে পৌছানেওয়ালার তুলনায় অধিক সংরক্ষণকারী হয়। তােমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তখন তােমরা কী বলবে? সমবেত সকলে সমস্বরে উত্তর দিলেন : আমরা সাক্ষ্য দেব, আপনি নিশ্চয় আপনার ওপর অর্পিত আমানত আদায় করেছেন, রিসালতের দায়িত্ব যথাযথ আনজাম দিয়েছেন এবং সকলকে নসিহত করেছেন । রিসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশের দিকে পবিত্র শাহাদাত অঙ্গুলি তুলে আবার নিচে মানুষের দিকে নামালেন । হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।.....

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url