বাংলা রচনা : শিশুশ্রম
শিশুশ্রম
অথবা, শিশুশ্রম ও বাংলাদেশ
[ সংকেত : ভূমিকা; কারা শিশু; শিশুশ্রম কী; শিশুশ্রমের হার কত; শিশুশ্রমের ধরন; বাংলাদেশে শিশুশ্রম; বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের জীবনমান; বাংলাদেশে শিশুশ্রমের কারণ; শিশুশ্রমের কুফল; শিশুশ্রম বন্ধের উপায়; উপসংহার । ]
ভূমিকা : আজকের শিশু আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। তাই শিশুদের সচেতন ও দক্ষ নাগরিক এবং যােগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তােলার দায়িত্ব আমাদের। উন্নত দেশে শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সেভাবেই তাদের পরিচর্যা করা হয় । কিন্তু আমাদের দেশের শিশুরা তেমন পরিচর্যা পায় না বরং উপার্জনে নেমে পড়ে। বর্তমানে শিশুশ্রম আমাদের দেশে জটিল সমস্যা সৃষ্টি করেছে। শিশুশ্রম একটি অমানবিক সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা মােকাবিলা করার জন্য আমাদেরকে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।
কারা শিশু : শিশুশ্রম বিষয়টি জানার আগে আমাদের জানতে হবে কাদের শিশু বলা হয়। শিশুদের বয়স নির্ধারণে মতানৈক্য রয়েছে । জাতিসংঘ শিশু সনদে ১৮ বছরের কম বয়সি সকলকে শিশু বলা হয়েছে। অর্থাৎ জাতিসংঘের আইন ও নীতি প্রযােজ্য অনুযায়ী ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ছেলেমেয়েকে শিশু হিসেবে ধরা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ শিশুনীতি ১৯৯৪-এ শিশুদের বয়স ধরা হয়েছে। ১৪ বছর বয়সিদের। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশে মােট জনসংখ্যার প্রায় ৩২.৩% শিশু। সংবিধিবদ্ধ আইনের ধারা অনুযায়ী শিশু বলা হয়েছে তাদের, যাদের বয়স ১৭ বছরের চেয়ে অনেক কম। আবার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ১১ বছর পর্যন্ত শিশুদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। পেনাল কোডের ধারায় শিশুদের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ বছরের কম । তাছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি আইনে ১৫ বছরের কম বয়সিদের শিশু বলা হয়েছে।
শিশুশ্রম কী : অপরিণত বয়সে শারীরিক ও মানসিক যেকোনাে ধরনের পরিশ্রমকেই শিশুশ্রম বলে। অপরিপক্ক ও অপরিণত বয়সে সকলেই শিশু। এ বয়স যেমন বর্ধনশীল তেমনি চাহিদাও থাকে অনেক বেশি। দরিদ্র এবং অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু পায় না। ফলে তারা অপরিণত বয়সে উপার্জন করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে শিশুর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর পর্যন্ত । জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর ঘােষণায় আঠারাে বছর বয়স পর্যন্ত যেকোনাে ধরনের শারীরিক ও মানসিক শ্রমকে শিশুশ্রম বলা হয়েছে এবং এ বয়সে সকল প্রকারের শ্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
শিশুশ্রমের হার কত : বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে অনেক শিশু শ্রমিক আছে। সিএসআইডি সংস্থার গবেষণা অনুসারে দেখা যায়, গত দশ বছরে আমাদের দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। দশ বছর আগে বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ, এখন তা প্রায় ২৫ লাখে নেমেছে। আইএলওর রিপাের্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ১৭ কোটি শিশু শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯ কোটিই ঝুঁকিপূর্ণ। শ্রমের সাথে জড়িত। শিশু শ্রমিকের প্রায় অর্ধেক মেয়ে শিশু। যাদের বেশিরভাগই গৃহকাজে কর্মরত।
শিশুশ্রমের ধরন : বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে দরিদ্র পরিবারে অর্থের অভাব লেগেই থাকে। ফলে কোনােকিছুতেই সংসারের চাহিদা মিটানাে সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে শিশুরাও উপার্জনে নেমে পড়ে। অভাবের তাড়নায় বাবা-মা সন্তানদের স্কুলে দিতে পারে না, অল্প বয়সে শিশুদের পাঠাতে হয় কর্মক্ষেত্রে। ফলে অপরিণত বয়সে শিশুরা কঠিন পরিশ্রমে নিয়ােজিত হচ্ছে। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সামান্য উপার্জন করছে। বড়ােদের মতাে শিশুরাও বিভিন্ন প্রকার কাজে অংশ নিচ্ছে। ফুল বিক্রেতা, কুলি, রিকশা চালক, হকার, বাসের হেলপার, ইট ভাঙা, ময়লা পরিষ্কার করা, পলিথিন ও বােতল সংগ্রহ, মাদক বাহক, হােটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, পােশাক শ্রমিক আজ শিশুরা।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হলেও এদেশের মােট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। তাই বাংলাদেশে শিশুশ্রম মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গ্রামের দরিদ্ররা অনেক টাকা উপার্জন করার আশায় শহরে আসে। তাদের ধারণা শহরে অনেক টাকা। কিন্তু শহরে এসে তারা চরম বিপদের সম্মুখীন হয়। রােদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার পাশে কোনােরকমে রাত কাটায়। পুরুষের সামান্য উপার্জনে অভাব দূর করতে না পারায় মহিলারাও কাজে নামে। কাজ করে মানুষের। বাসাবাড়িতে। এতেও যখন সংসারের অভাব দূর হয় না, তখনই শুরু হয় সংসারে অশান্তি। অনেক সংসারে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটে। বাধ্য হয়ে অল্প বয়সে দরিদ্র পরিবারের শিশুটি পাঠশালা আর খেলার মাঠের পরিবর্তে উপার্জন করতে শেখে। সারাদিন কাজ করেও শিশুরা শ্রমের যথার্থ মূল্য পায় না।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের জীবনমান : বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও শিশুদের জীবনের ঝুঁকি কমেনি। এক জরিপে বাংলাদেশের শিশুদের জীবনমান পরিমাপ করা হয় । এই জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫৬ ভাগ শিশু শ্রমিক ভাসমান জীবন পার করছে, আর ৪৪ ভাগ কোনােরকমে গৃহে বাস করে। জরিপে আহারের বিষয়ে বলা হয়েছে, শতকরা ৫৩ ভাগ শিশু শ্রমিক দুবেলা আহার করে আর এক বেলা অনাহারে থাকে এবং ৪৭ ভাগ তিন বেলা আহার করতে পায়, ৫৬ ভাগ ভাত খায়, ৪৪ ভাগ রুটি খায়। শিশু শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের ওপর জরিপ করে দেখা গেছে, শতকরা ৬১ ভাগ রুগ্ণ স্বাস্থ্যের অধিকারী, ৩৯ ভাগ | মাঝারি স্বাস্থ্যের অধিকারী। একই জরিপে শিশু শ্রমিকদের উপার্জন দেখানাে হয়েছে শতকরা ৬২ ভাগ শিশু শ্রমিক দিনে উপার্জন করে ২০ টাকা, ২১ ভাগ ২০-৩০ টাকা এবং ১৭ ভাগ ৩০ টাকার সামান্য বেশি উপার্জন করে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমের কারণ : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু এদেশে এখনও প্রায় শতকরা ৩০ শতাংশ মানুষ। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে । দরিদ্র মানুষেরা যখন নিজেদের উপার্জনে সংসার চালাতে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন অপরিণত বয়সে শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে বেকারত্বও বাড়ছে। ছেলেমেয়ে শিক্ষিত করার পর কাজের নিশ্চয়তা থাকে না বলে অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠায়। তাছাড়া যে পরিবারে সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের আর্থিক সংকটও বেশি। তাই পরিবারের অভাব মিটাতে শিশুরা অল্প বয়সেই কাজে যেতে বাধ্য হয়। যার ফলে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিশুশ্রমের কুফল : শিশুশ্রম একটি মানবতা বিরােধী কাজ। অভাবের তাড়নায় অভিভাবকরা শিশুদের কাজে পাঠিয়ে যদিও সাময়িক সামান্য সুফল ভােগ করে, আসলে তার কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। শিশুশ্রম দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক অভিশাপ। তাছাড়া অপরিণত বয়সে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে শিশুরা অপুষ্টিজনিত নানা রােগে ভােগে এবং স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের রােগের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তারা আর কখনাে সুস্বাস্থ্য ফিরে পায় না। ফলে তারা দেশ ও জাতির কোনাে উপকারে আসে না।
শিশুশ্রম বন্ধের উপায় : অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিশুশ্রম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুশ্রম যতই বৃদ্ধি পাবে দেশ ও জাতি ততই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করা আমাদের কর্তব্য। এ ব্যাপারে সরকার আইন প্রণয়ন করলেও শুধু আইনের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে সকলকে সচেতন হতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং দারিদ্র বিমােচনে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং সমাজকল্যাণমূলক সংস্থাগুলােকেও এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ না করতে পারলে অচিরেই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।
উপসংহার : বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার রােধ করতে না পারলে মানবতার বিকাশ ব্যাহত হবে। দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য শিশুশ্রম রােধ করা জরুরি কর্তব্য। শিশুশ্রমের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, অর্থোপার্জনে নিয়ােজিত শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না বলে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। প্রতিটি দেশের সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে শিশুশ্রম বন্ধে সােচ্চার হতে হবে। তাছাড়া গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেলে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হবে ।
nice
আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। আশা করি আমাদের সাথে থাকবেন।