বাংলা রচনা : নারী শিক্ষার গুরুত্ব
নারী শিক্ষার গুরুত্ব |
নারী শিক্ষার গুরুত্ব
অথবা, নারী শিক্ষা ও জাতীয় উন্নয়ন
অথবা, জাতীয় উন্নয়ন ও নারী সমাজ
অথবা, একবিংশ শতাব্দীর নারী সমাজ
অথবা, জাতীয় উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা
অথবা, জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা
[ সংকেত : ভূমিকা; নারী শিক্ষার গুরুত্ব: বাংলাদেশে নারী শিক্ষার বর্তমান অবস্থা; উন্নত দেশে নারী শিক্ষার অবস্থা; জাতীয় জীবনে নারী শিক্ষা; শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর প্রভাব; স্বাবলম্বী হবার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার অবদান; দেশ গঠনে নারী শিক্ষার অবদান; নারী শিক্ষা বিস্তারে করণীয়; নারী শিক্ষা প্রসারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ; গৌরবময় কৃতিত্বে মুসলিম নারী; উপসংহার । ]
ভূমিকা :
কোনাে কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত এই চরণ প্রমাণ করে যে, সকল ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রয়েছে। কোনাে কালেও। নারীর সহায়তা ছাড়া পুরুষ জয়ী হতে পারেনি। নারী মানবজাতির এক বিরাট অংশ। বর্তমান যুগে দিকে দিকে নারীর জয়ধ্বনি বিঘঘাষিত হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে নারী ছিল পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। এখন নারীজাতি স্বাবলম্বী। একসময় নারীর পরিচয় ছিল কন্যা, ভগ্নি, মাতা ও পত্নীরূপে। আর সর্বত্রই নারীরা ছিল অসহায়। কিন্তু নারীরা সেই দুর্দিনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আজ আলােকিত জগতের উদার প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছেছে। মানব সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান ভূমিকা রয়েছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে উভয়কে সমান তালে অগ্রসর হতে হবে । আর সেজন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীদের শিক্ষার প্রয়ােজন, নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে ।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব : মানবজাতির মনুষ্যত্ববােধের বিকাশ ঘটাতে শিক্ষার প্রয়ােজন। শিক্ষা মানুষকে আলাের পথ দেখায়। একটি দেশ, একটি জাতির উন্নয়নের জন্য সবার আগে চাই শিক্ষা। আর একটি জাতিকে শিক্ষিত হতে হলে সবার আগে চাই শিক্ষিত মা ।। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। তাছাড়া নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে ও জাতীয় জীবনকে সার্থক ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও শিক্ষিত হতে হবে। মেধা ও যােগ্যতায় নারীদের পিছনে ফেলে রাখার প্রশ্নই আসে না। শিক্ষার মাধ্যমে একজন নারী নিজেকে যােগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। তাছাড়া উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন ও বলিষ্ঠ জাতিগঠনে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নে নারী শিক্ষার ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে ।
বাংলাদেশে নারী শিক্ষার বর্তমান অবস্থা : অতীতের সমাজব্যবস্থা অনেকটা পালটালেও বর্তমান সমাজে শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীপুরুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, দিকে দিকে নারীদের প্রগতির জয়গান ধ্বনিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নারীরা একসময় গৃহবন্দি ছিল, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল, অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল এবং পদে পদে অবহেলার শিকার হতাে। কিন্তু এখন আর সেই যুগ নেই। এখন সময় এসেছে অধিকার আদায়ের। এই আধুনিক যুগে বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষার অধিকার পাচ্ছে, নিজের প্রচেষ্টায় ভাগ্যকেও পরিবর্তন করতে পারছে, নারীরা আজ বুঝতে পেরেছে আপন ভাগ্য তাদের নিজেদের হাতের মুঠোয় ।
উন্নত দেশে নারী শিক্ষার অবস্থা : উন্নত দেশে নারী শিক্ষার অবস্থান আজ সর্বোচ্চ শিখরে । তাই সর্বক্ষেত্রে নারীদের অবস্থাও সুদৃঢ় ।। তার একমাত্র কারণ হলাে উন্নত দেশে কখনাে নারী-পুরুষদের আলাদাভাবে দেখা হয় না। পড়ালেখায়, কর্মক্ষেত্রে, পারিবারিক কাজে উভয়ের রয়েছে সমান অধিকার। তারা কেউ কাউকে ছােটো করে দেখে না, তাদের মধ্যে কোনাে ভেদাভেদ নেই । আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, জার্মানি প্রভৃতি দেশের সকল ক্ষেত্রে উভয়েই সমান পারদর্শী। এসব দেশের নারীরা পুরুষের মুখাপেক্ষী নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে ।
জাতীয় জীবনে নারী শিক্ষা : একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌছে দিতে পারে নারীসমাজ। তাই জাতির উন্নয়নের জন্য নারীসমাজকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষিত নারীরাই জাতির বৃহত্তম স্বার্থ পূরণের অন্যতম হাতিয়ার। আমাদের দেশের নারীরা সাধারণত গৃহিণী ও জননী রূপে বিবেচ্য হলেও তারা আজ এ গণ্ডি পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সংসার জীবনেও সুখশান্তি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে নারীদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। একজন শিক্ষিত নারীই পারে সংসারের সুখ, শান্তি, আয়, উন্নতি সবকিছু ঠিক রাখতে। শিক্ষিত নারীরা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের রুচি, চাহিদা, মানসিক অবস্থা বুঝতে সক্ষম, যা । অশিক্ষিত নারীর পক্ষে অসম্ভব। আজকের শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার। আর এই শিশুদের গড়ে তােলার জন্য চাই আদর্শ মা। শিশুরা যদি আদর্শবান হয়ে গড়ে না ওঠে তাহলে অচিরেই জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আদর্শ জননী হিসেবে আদর্শ সন্তান গড়ে তােলার জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষা। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে ও জাতীয় জীবনে উন্নতি সাধন করতে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর প্রভাব : শিক্ষাক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান অনেক বেশি। কারণ প্রতিটি সন্তানই তার মায়ের কোলে বড়াে হয়। বাবার চেয়ে মা অনেক বেশি সময় সন্তানের পিছনে ব্যয় করেন। ফলে সন্তান মায়ের আদর্শে গড়ে ওঠে। একজন শিক্ষিত মা-ই তার সন্তানকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে পারেন, যা অশিক্ষিত মায়ের পক্ষে সম্ভব নয় । শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে নেপােলিয়ন বলেছেন- “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তােমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।
স্বাবলম্বী হবার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার অবদান : অতীতে পুরুষের কাছে নারীরা ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত। কারণ নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হতো। তখন পুরুষরা স্বাবলম্বী ছিল, নারীরা স্বাবলম্বী ছিল না। কিন্তু এখন নারীরা শিক্ষা অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। একজন নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলতে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অতীতকালে নারী ছিল শুধু গৃহিণী। তাদের কার্যাবলি সীমাবদ্ধ ছিল। এখন নারীরা শুধু গৃহকর্মে সীমাবদ্ধ নয়। তারা আজ শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, ব্যাংকার, সৈনিক, বৈমানিক, পুলিশ অফিসারসহ বিবিধ দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি নারীরা একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, স্পিকারের দায়িত্বও পালন করছে। এখন নারীদের অবহেলা করার কোনাে সুযােগ নেই। নারীদের অবহেলা করার দিনের আজ অবসান ঘটেছে। তাইতাে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন一
সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা আছিল দাসী!
দেশ গঠনে নারী শিক্ষার অবদান : একটি দেশ গঠনে শিক্ষিত নারীরা যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। অতীতকাল থেকে নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে দেশ গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে শিক্ষিত নারীরা দেশ গঠনের কাজে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে অবদান রাখছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত যত মহৎ কর্ম সাধিত হয়েছে প্রতিটি মহৎ কর্মেই নারীরা পুরুষদের প্রেরণা যুগিয়েছে, কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীরা অংশগ্রহণ করেছে। আর যারা এসব ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে তারা প্রায় সকলেই শিক্ষিত নারী । তাই বলা যায়, দেশ গঠনের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার অবদান অপরিসীম।
নারী শিক্ষা বিস্তারে করণীয় : একটি দেশের সার্বিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারী জাতি শিক্ষিত হলে দেশের উন্নয়ন সহজ হবে না। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য কতকগুলাে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পদক্ষেপগুলাে হলাে—
১. নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে ।
২. নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ছাত্রীদের নির্যাতন না করার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে ।
৪. শিক্ষা গ্রহণে নারীদের উৎসাহিত করতে হবে।
৫. মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে বাবা-মাকে সচেতন থাকতে হবে।
৬. বয়স্ক নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে ।
৭. সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে ।
৮. নারী শিক্ষার জন্য প্রদত্ত উপবৃত্তি যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে ।
নারী শিক্ষা প্রসারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : বর্তমান যুগের শিক্ষিত নারীরা ঘরে-বাইরে সমান অবদান রাখছে। শিক্ষিত নারীরাই সংসার চাকরি রাজনীতি সব কাজ একসাথে করতে পারে। যেমন- আমাদের দেশের সরকার প্রধান এবং বিরােধী দলীয় নেত্রী দুজনই নারী, স্পিকারও নারী । তাছাড়া অন্যান্য দেশেও নারী প্রধানমন্ত্রী রয়েছে। তাই নারী শিক্ষার ব্যাপারে সরকারকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যতগুলাে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সরকার নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিনা বেতনে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, মেয়েদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন, বয়স্ক নারীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বয়স্ক নারী-শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেছেন।
গৌরবময় কতিতে মুসলিম নারী : মুসলমান নারীরা শিক্ষিত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অবদান রেখেছেন। আরব ও স্পেনের মহিলাগণ তাদের গৌরবময় কতিত্বের জন্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের অবরােধ বাসিনীদের মুক্তির জন্য, অন্তঃপর থেকে নারীদের বেরিয়ে আসার জন্য যিনি অবদান রেখেছিলেন, তিনি হলেন রােকেয়া সাখাওয়াৎ হােসেন। তাই তাকে বাঙালি নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়।
উপসংহার : একসময় নারীরা ঘরে বন্দি থাকত । শিক্ষার আলাে তাে দূরের কথা সূর্যের আলাের দেখা পেতেও তাদের অনেক ঝামেলা পােহাতে হতাে। কিন্তু আজ নারীরা নিজেদের প্রচেষ্টায় শিক্ষার আলােয় নিজেদের আলােকিত করেছে। আর নারীরা শিক্ষিত হওয়ার পর থেকে জাতিও উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধির পিছনে নারী শিক্ষার অবদান অনেক বেশি । শিক্ষিত নারীরা আজ পুরুষের পাশাপাশি ঘরে-বাইরে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। আর পুরুষের কাজে নারীরা প্রেরণা দিয়ে পুরুষের কাজকে ত্বরান্বিত করছে। পৃথিবীর যত বড়াে বড়াে কাজে পুরুষেরা সফল হয়েছে তা নারীর প্রেরণার জন্যই। এখন নারী-পুরুষের মধ্যে অধিকারের ক্ষেত্রে কোনাে ভেদাভেদ নেই। কাজী নজরুল ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন一
সাম্যের গান গাই一
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনাে ভেদাভেদ নাই ।
নারীরা সর্বক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নিজেদের যােগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। নারী শিক্ষা নারীকে তার অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তুলছে। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য চাই নারী শিক্ষা।