বাংলা রচনা : বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প |
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প
অথবা, বাংলাদেশের ছোটগল্প
[ সংকেত : ভূমিকা; ছোটগল্প; রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ছোটগল্প; ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য; রবীন্দ্রনাথের হাতে ছোটগল্প; রবীন্দ্রানুসারী লেখকবৃন্দ; কল্লোল যুগের লেখকবৃন্দ; কল্লোল পরবর্তী যুগের লেখকবৃন্দ; বাংলাদেশের ছোটগল্প ও গল্পকার; বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ; সাম্প্রতিক কালের বাংলা ছোটগল্প; উপসংহার । ]ভূমিকা : ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ শিল্প প্রকরণ । জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি থেকে একটি বিশেষ খণ্ড মুহূর্তের কথা শিল্প নৈপুণ্যে গভীর তাৎপর্যময় করে তােলাই ছোটগল্পের ধর্ম। ছোটগল্প সম্পর্কে Somerset Maugham বলেছেন, “The desire to listen to stories appears to be as deeply rooted in the human animal as the sense of property. From the beginning of history men have gathered round the camp-fire, or in a group in the market place to listen to the telling of a story. শুধু সংক্ষিপ্ততা, একমুখিতা ছোটগল্পের উদ্দেশ্য নয় বরং গভীর ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা, খণ্ডের মধ্যে অখণ্ডের পরিচয়, সীমার মধ্যে অসীমের ইঙ্গিত, বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর দর্শনই সার্থক ছোটগল্পের প্রাণ । ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব সংযােজন, যা পাশ্চাত্য সাহিত্য হতে গৃহীত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছোটগল্প জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ছোটগল্প : সৃজনী গদ্যসাহিত্যের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শিল্পরূপ ছছাটোগল্প বা Short Story, যাকে সহজ করে বলা যায় সংক্ষিপ্ত গদ্য আখ্যায়িকা। ছোটগল্প একদিকে যেমন নতুন অপরদিকে তেমন পুরাতন । গল্প এবং আকৃতিতে ছােট হলেই ছোটগল্প হয় না। আকৃতিগত ব্যতীত প্রকৃতিগত এবং মর্মগত অনেক বিভিন্নতা ছোটগল্পকে উপন্যাস থেকে আলাদা করেছে। এডগার এলান পাে বলেছেন, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে।' H.G. Wells বলেন, ছোটগল্প ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয় । শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, একটি ক্ষুদ্র আখ্যানে সমগ্র জীবনের তাৎপর্য প্রতিবিম্বিত করাই ছোটগল্পের উদ্দেশ্য ও প্রেরণা। মূলত ছোটগল্পের মধ্যে মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলাে ফুটে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ছোটগল্প : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প অগ্রসর হয়েছে। ছোটগল্প আকৃতিতে ছোট ও প্রকৃতিতে গল্প হলেও সাহিত্যের এমন এক শিল্প প্রকরণ, যার সঙ্গে উপন্যাস বা নাটকের তুলনা হয় না। ছোটগল্পের এই স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক সমালােচক দীর্ঘ আলােচনা করেছেন । রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্যতম কাব্যগ্রন্থ হলাে ‘সােনারতরী'। এ কাব্যের বর্ষাযাপন' কবিতায় কবি ছোটগল্পের শিল্পরূপ ও প্রকরণ রহস্যকে চমৎকারভাবে উদঘাটন করেছেন এভাবেㄧ
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল ।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ ।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য : ছোটগল্প লেখকের আত্মসচেতন সৃষ্টি। ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রকারের গঠনরীতি, বিষয়বস্তু চয়ন, চরিত্র সৃষ্টি, কথােপকথন, পরিবেশ সৃষ্টি, বাণীভঙ্গি প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা হয়। ছোটগল্প প্রসঙ্গে, E.A. Poe বলেন"In the whole composition there should be no word written of which the tendency direct or indirect, is not to the one pre-established design ... undeue brevity is just as exceptionable here as in the poem; but undue length is yet more to be avoided." ছোটগল্পকে কোনাে নির্দিষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। ছোটগল্পে লেখক-পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তি, অনুভূতি অথবা অন্তরতম প্রদেশ পর্যন্ত আলােড়িত করতে পারেন কিন্তু অবশ্যই তাঁকে যেকোনাে অবান্তর কাহিনি বা রসভঙ্গকারী ব্যাপার বর্জন করতে হবে। সর্বোপরি একটি আদর্শ ছোটগল্প, মাত্র একটিই, মহামুহূর্ত বা ক্লাইমেক্স দ্বারা আবর্তিত।
রবীন্দ্রনাথের হাতে ছোটগল্প : সাহিত্যম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহােদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘মধুমতী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছছাটোগল্প । তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার বলা হয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের হাতেই ছোটগল্প নতুন রূপ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মননের ব্যাপ্তিতে, বাপ্রীতির তির্যক বৈদগ্ধ্যে, সৌন্দর্যানুভূতির সুকোমল সূক্ষ্মতায়, মনস্তত্ত্বের জটিল বিশ্লেষণে, আবেগের উষ্ণতায় ছােটগল্প হয়েছে সমৃদ্ধ । তার গল্প আরম্ভ হয় দ্রুত, অবিলম্বে তিনি গল্পের মধ্যে পাঠককে টেনে আনেন এবং গল্পের শেষ করেন সেখানেই, যেখানে পাঠকমন কাহিনি সম্পর্কে সবচেয়ে কৌতূহলী। এরূপ ছোটগল্পের তালিকার মধ্যে রয়েছে- পােস্টমাস্টার, খােকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কঙ্কাল, একরাত্রি, কাবুলিওয়ালা, ছুটি, সুভা, শাস্তি,সমাপ্তি, মেঘ ও রৌদ্র, অতিথি, রাজটিকা, দৃষ্টিদান, শুভদৃষ্টি, নষ্টনীড়, মাল্যদান, গুপ্তধন, মাস্টারমশায়, হৈমন্তী, স্ত্রীর পত্র, শেষের | রাত্রি, অপরিচিতা, ছোটগল্পগুলাে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
রবান্দ্রানুসারা লেখকবৃন্দ : বাংলা ছোটগল্পের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ এবং তিনিই এর সিদ্ধিদাতা। তিনি এক অপূর্ব ও গতিশীল গদ্যে, নাটক ও কাহিনির অনবদ্য মেরুমিলন ঘটিয়ে, মনস্তত্ত্বের গৃঢ়তায় ও সূক্ষ্ম সাংকেতিকতায় ছোটগল্পকে তার স্বর্ণশিখরে উত্তীর্ণ করেছিলেন। তার পােস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘অতিথি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ প্রভৃতি গল্প বিশ্বসাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। রবীন্দ্র সমকালীন গল্পকারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও ত্রৈলােক্যনাথ মুখােপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় প্রমুখ। বিশেষ করে ত্রৈলােক্যনাথের সরসতা ও প্রভাত কুমারের সকরুণ প্রসন্নতা পাঠকদের আকৃষ্ট করেছিল। প্রভাতকুমারের। শতাধিক প্রকাশিত গল্পের মধ্যে ‘দেবী’, ‘আদরিনী’ ও ‘রসময়ীর রসিকতা’ প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য । গল্পলেখক হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও পাঠকমহলে বিশেষ সমাদৃত। গঠনরীতির শৈথিল্য সত্ত্বেও শরৎচন্দ্রের বেশ কয়েকটি ছোটগল্প যেমন ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ ও ‘বিলাসী’ নিদারুণ মর্মস্পর্শী ও মানবিক আবেদনে মণ্ডিত। রবীন্দ্রানুসারী ছোটগল্প লেখক রূপে আরও উল্লেখ করতে হয়- চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম চৌধুরী, জগদীশ গুপ্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সৌরীন্দ্রমােহন মুখােপাধ্যায় প্রমুখ।
কল্লোল যুগের লেখকবৃন্দ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-অনুবর্তনের বিরুদ্ধে দ্রোহ গড়ে তুলেছিল কল্লোল’কালিকলম’-প্রগতি’র প্রতিবাদী শিবির। এই শিবিরভুক্ত প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখােপাধ্যায় প্রমুখ বাংলা ছোটগল্পে সঞ্চার করেছিলেন সমাজবাস্তবতার এক নবপ্লাবন। অস্থিরতা ও ভ্রষ্টাচার লাঞ্ছিত আধুনিক জীবনচরিতমানস তথা অন্ধকার ও অবক্ষয়ের গর্ভ থেকে মানবাত্মার উত্তরণের সংকেত ঘােষিত হয়েছিল এঁদের কলমে। এ প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’, ‘তেলেনপােতা আবিষ্কার’, অচিন্ত্যকুমারের ‘বেদে’-র মতাে ছোটগল্প । কল্লোল' পর্বে বাংলা ছোটগল্পে আত্মপ্রকাশ হয় তারাশংকর-বিভূতিভূষণ-মানিক- এই আশ্চর্য শক্তিধর বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রয়ীর । কয়লাকুণ্ঠী’র লেখক শৈলজানন্দের অনুসরণে, তারাশংকর রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক জীবনবৃত্তের প্রত্যক্ষ ও প্রত্যয়ী অভিজ্ঞতা ও অনুভবসমূহকে রূপ দিয়েছিলেন তাঁর কালজয়ী গল্পমালায়, তারিণী-মাঝি’, ‘বেদেনী’, ‘শেষ কথা' প্রভৃতি গল্পে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লেদপঙ্কিল জীবনাবর্ত আর সংগ্রামী। সমষ্টিচেতনার এক অসামান্য সংবেদনশীল রূপকার। তাঁর প্রথম যুগের ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সর্পিল’ ও ‘টিকটিকি'-র মতাে গল্পে। ফ্রয়েডীয় যৌনভাবনার প্রভাব স্পষ্ট । তারাশংকর ও মানিকের পাশাপাশি এক আশ্চর্য স্বকীয়তায় দাঁড়িয়েছিলেন অনন্য বিভূতিভূষণ ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরিফুল’, ‘কিন্নরদল’-এর মায়াবী লেখক। এঁদেরই সমকালে কল্লোল’, ‘বিচিত্রা’, ‘শনিবারের চিঠি' ইত্যাদির পাতায় আর যারা প্রশংসনীয় বৈচিত্রে বাংলা ছোটগল্পের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে স্মরণীয় নামগুলাে হলাে- অন্নদাশংকর রায়, প্রবােধকুমার সান্যাল, বনফুল, সরােজকুমার রায় চৌধুরী, মনােজ বসু, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সজনীকান্ত দাস প্রমুখ।
কল্লোল পরবর্তী যুগের লেখকবৃন্দ : কল্লোল’ পরবর্তী যুগপর্ব অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা ও দেশবিভাগের মধ্যবর্তী সময়কাল মন্বন্তর, দাঙ্গা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও উদ্বাস্তুস্রোতে আলােড়িত ও বিপর্যস্ত এক যুগ। এই যুগের বিপন্নতা ও বিক্ষোভ, স্বপ্ন ও অঙ্গীকার যাদের ছোটগল্পে আভাসিত হয়েছিল তাঁরা হলেন— সুবােধ ঘােষ, সতীনাথ ভাদুড়ী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘােষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নবেন্দু ঘােষ প্রমুখ । তাছাড়া এই কালপর্বের পুরােভাগ জুড়ে ছিলেন- সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরকিশাের ঘােষ, আশুতােষ মুখােপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, প্রফুল্ল রায়, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী, মহাশ্বেতা দেবীসহ অনেকে।
বাংলাদেশের ছোটগল্প ও গল্পকার : ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতাে কাব্যসাহিত্য এবং কথাসাহিত্য উভয় দিকেই উন্নতি সাধিত হয়েছে। বাংলা ছোটগল্পের অধিকাংশ লেখকই একাধারে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক । এঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, আবু রুশদ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শওকত আলী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, বােরহান উদ্দীন খান, আজিজুল হক উল্লেখযােগ্য।
আবুল মনসুর আহমদ বিভাগপূর্ব কাল থেকেই ব্যঙ্গগল্প রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত। সমাজের ও রাজনীতিক বিভিন্ন অসংগতি তাঁর গল্পে সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অন্যতম। তাঁর গল্পে রয়েছে গভীর ব্যঞ্জনা ও শিল্প জিজ্ঞাসা। তাঁর উল্লেখযােগ্য গল্পগ্রন্থ হলাে— 'নয়নচারা’ ও ‘দুইতীর'। শওকত ওসমানও বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম কথাসাহিত্যিক । তাঁর গল্পে অপূর্ব রসানুভূতির ধারালাে বক্তব্য, তীক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং দরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর রচিত গল্পের মধ্যে রয়েছে, ‘জুনু আপা’, ‘ডিগবাজী’, ‘সাবেক কাহিনী' প্রভৃতি। সরদার জয়েনউদ্দীন একজন সমাজ সচেতন গল্পকার। তাঁর রচিত নয়ান ঢুলি’, ‘খরস্রোতা' গল্পগ্রন্থে সাধারণ গ্রামীণ চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । আলাউদ্দিন আল-আজাদ একজন শক্তিমান ছোটগল্পকার। তাঁর রচনাগুলাে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ও বিষয়ােপযােগী। তাঁর উল্লেখযােগ্য রচনার মধ্যে রয়েছেধানকন্যা, জেগে আছি, অন্ধকার সিড়ি, মৃগনাভি প্রভৃতি । হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি একটি সার্থক। ছোটগল্প । তাছাড়া জহির রায়হানের ‘সূর্যগ্রহণ', আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘সম্রাটের ছবি’ প্রভৃতি গল্পগুলােও সার্থক ছোটগল্প রূপে সমাদৃত।
আবুল মনসুর আহমদ বিভাগপূর্ব কাল থেকেই ব্যঙ্গগল্প রচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত। সমাজের ও রাজনীতিক বিভিন্ন অসংগতি তাঁর গল্পে সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অন্যতম। তাঁর গল্পে রয়েছে গভীর ব্যঞ্জনা ও শিল্প জিজ্ঞাসা। তাঁর উল্লেখযােগ্য গল্পগ্রন্থ হলাে— 'নয়নচারা’ ও ‘দুইতীর'। শওকত ওসমানও বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম কথাসাহিত্যিক । তাঁর গল্পে অপূর্ব রসানুভূতির ধারালাে বক্তব্য, তীক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং দরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর রচিত গল্পের মধ্যে রয়েছে, ‘জুনু আপা’, ‘ডিগবাজী’, ‘সাবেক কাহিনী' প্রভৃতি। সরদার জয়েনউদ্দীন একজন সমাজ সচেতন গল্পকার। তাঁর রচিত নয়ান ঢুলি’, ‘খরস্রোতা' গল্পগ্রন্থে সাধারণ গ্রামীণ চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । আলাউদ্দিন আল-আজাদ একজন শক্তিমান ছোটগল্পকার। তাঁর রচনাগুলাে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ও বিষয়ােপযােগী। তাঁর উল্লেখযােগ্য রচনার মধ্যে রয়েছেধানকন্যা, জেগে আছি, অন্ধকার সিড়ি, মৃগনাভি প্রভৃতি । হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি একটি সার্থক। ছোটগল্প । তাছাড়া জহির রায়হানের ‘সূর্যগ্রহণ', আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘সম্রাটের ছবি’ প্রভৃতি গল্পগুলােও সার্থক ছোটগল্প রূপে সমাদৃত।
বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ : বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ও প্রভাব লক্ষণীয় বিষয়। বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত । দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আছে বাংলাদেশের জন্মবেদনা থেকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস । এরই ধারাবাহিকতা ধারণ করে গল্পকাররা অগ্রসর হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প লিখেছেন- বশীর আল হেলাল ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া, হাসান আজিজুল হকের নামহীন গােত্রহীন', সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলাে', শওকত ওসমানের ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমার রক্ত, স্বপ্ন খামার’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা', আবুবকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা'। এছাড়া আমজাদ হােসেন, হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হােসেন, রশীদ হায়দার, হুমায়ুন আজাদ, রাহাত খান, সত্যেন সেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মঈনুল আহসান সাবের ও বিপ্রদাশ-এর গল্পে আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন। মূলত মৌলিক গল্পকারগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ ও বরণ করেই গল্প লিখেছেন।
সাম্প্রতিক কালের বাংলা ছোটগল্প : সাম্প্রতিক সময়ে তথা আধুনিকতা থেকে উত্তর আধুনিকতার উত্তরণ পর্বে বাংলা ছোটগল্প পরিবর্তিত হয়েছে। গল্পের ভাব, ভাষা ও আঙ্গিকে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বলাইচাঁদ মুখােপাধ্যায় (বনফুল)-এর অনুসরণে অনুগল্পের ধারাটি আজ বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছে। পরাবাস্তববাদ, মনােবিকলন ও বিকৃত ভাবনা ছোটগল্পে এক ভিন্নমাত্রা যােগ করেছে। বর্তমান সময়ের গল্পকারদের মধ্যে মাহমুদুল হক, সুচরিত চৌধুরী, শামীম কবির, মােস্তফা কামাল, মহীবুল আজিজ, খন্দকার আশরাফ হােসেন, হুমায়ুন মানিক, মহফিল হক, জিয়া জামান, প্রশান্ত মৃধা, জাকির তালুকদার, মনি হায়দার, সরকার আশরাফ, পাপড়ি রহমান প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
উপসংহার : ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠতম শাখা । সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় ছোটগল্পের বয়স অনেক কম হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর অতুলনীয় সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য ও প্রসার ঘটেছে। লেখক তার মনের ভাব গভীর ব্যঞ্জনার সহযােগে সাহিত্যে রূপ দান করেছেন। বর্তমান সময়ের প্রায় সব লেখকই বাস্তববাদী ও সমাজ সচেতন। তাঁরা রােমান্টিক ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গল্প লিখতে আরম্ভ করেছেন এবং সফলতাও অর্জন করেছেন। পাশ্চাত্য ছোটগল্পের অনুবাদ করেও বর্তমানে অনেক ছোটগল্পকার বিখ্যাত হয়েছেন।