বাংলা রচনা : তোমার শৈশব স্মৃতি
তোমার শৈশব স্মৃতি |
ফেলে আসা দিনগুলাে
অথবা, তোমার শৈশব স্মৃতি
অথবা, নানা রঙের দিনগুলাে
অথবা, যখন ছােটো ছিলাম
অথবা, শৈশব স্মৃতি
অথবা, কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা
অথবা, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি
[ সংকেত : সূচনা; আমার শৈশবকাল; বাবার স্মৃতি; মায়ের স্মৃতি; লেখাপড়ার স্মৃতি বৃষ্টির দিনের স্মৃতি; স্কুল পালানাের স্মৃতি; পাড়া বেড়ানাের স্মৃতি; মামা বাড়ির স্মৃতি; বন্ধুর স্মৃতি; উপসংহার। ]
সূচনা : দিন আসে, দিন যায়। মানুষের জীবনের স্মৃতির অ্যালবাম ঋদ্ধ হতে থাকে। কিছু স্মৃতি মন থেকে মুছে যায়, আর কিছু স্মৃতি কখনাে ভােলা যায় না। মাঝে মাঝে জীবনের অতীত পানে যখন ফিরে তাকাই, তখন ফেলে আসা বর্ণাঢ্য সুখস্মৃতি মানস চোখে। মায়াবী রূপে ধরা দেয়। সেই দিনগুলাে ছিল বড়াে সুন্দর, বড়াে রঙিন, বড়াে মধুময়। জীবন থেকে চলে যাওয়া শৈশব-কৈশােরের সেই দিনগুলাে আজও ভুলতে পারছি না। সে দিনগুলাের কথা মনে হলেই মন পুলকে ভরে ওঠে। কত রঙিন ঘটনা, কত উচ্ছাস, কত। উল্লাস মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। মনে মনে বলতে থাকি—
সে যে কাল হলাে কতকাল
তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল ।
তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল ।
আমার শৈশবকাল : গ্রামেই আমার শৈশব-কৈশাের অতিবাহিত হয়েছে। নরসিংদী জেলার অন্তর্গত চর উজিলার একটি সুন্দর ছােট্ট গ্রাম। এ গ্রামেই বেড়ে উঠেছি আমি। নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ গ্রামটি সত্যিই অপূর্ব। বাবা চাকরিসূত্রে শহরে থাকতেন। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতেন। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল আর সুপারি গাছে ঘেরা ছায়া সুনিবিড় ছিল আমাদের বাড়িটি। দাদি, চাচা, ফুফু, ভাইবােন সবাই মিলে আমরা বাস করতাম । আমি ছিলাম পরিবারের সকলের আদরের । গ্রামের বন্ধুদের সাথে নদীতে সাঁতার প্রতিযােগিতায় মেতে উঠতাম, ঝড়ের দিনে দল বেঁধে আম কুড়াতাম, সারা গ্রাম হইচই করে ছুটে বেড়াতাম, গাছে উঠতাম, নদীর উপর ঝুঁকে থাকা গাছ থেকে লাফিয়ে পড়তাম, আরও কত কী।
বাবার স্মৃতি : বাবা ছিলেন আমার অকৃত্রিম বন্ধু । বাবা আমাকে লেখাপড়া, চলাফেরা সম্পর্কে নানা উপদেশ দিতেন। কী করলে প্রকৃত মানুষ হতে পারব সে কথা বলতেন । পরীক্ষার দিন বাবা বলতেনসবাইকে সালাম করতে হবে, দোয়া চাইতে হবে এবং প্রশ্ন বুঝে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে হবে । বাবার উপদেশগুলাে আমার জীবনে অনেক উপকারে এসেছে । তাছাড়া তিনি নানা মজার মজার গান ও গল্প শােনাতেন। আজ বাবা নেই, কিন্তু বাবার কথাগুলাে আজও আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে অক্ষয় হয়ে আছে।
মায়ের স্মৃতি : আমার শৈশব স্মৃতির মধ্যে মায়ের স্মৃতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । মাকে আমি ভুলতেই পারি না। মা যে আমাকে কতটা ভালােবাসতেন, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, মা তাঁর জীবনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালােবাসতেন। আমাকে সুখী দেখলে মা খুব খুশি হতেন, আমি একটু অসুস্থ হলে মা অস্থির হয়ে যেতেন। স্কুল বা অন্য কোথাও থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে মা উদ্বিগ্ন চিত্তে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। মায়ের মধুময় স্মৃতি মনে হলে আমার পক্ষে নিজেকে সামলানাে কষ্ট হয়। মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত গানটি—
বাবার স্মৃতি : বাবা ছিলেন আমার অকৃত্রিম বন্ধু । বাবা আমাকে লেখাপড়া, চলাফেরা সম্পর্কে নানা উপদেশ দিতেন। কী করলে প্রকৃত মানুষ হতে পারব সে কথা বলতেন । পরীক্ষার দিন বাবা বলতেনসবাইকে সালাম করতে হবে, দোয়া চাইতে হবে এবং প্রশ্ন বুঝে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে হবে । বাবার উপদেশগুলাে আমার জীবনে অনেক উপকারে এসেছে । তাছাড়া তিনি নানা মজার মজার গান ও গল্প শােনাতেন। আজ বাবা নেই, কিন্তু বাবার কথাগুলাে আজও আমার সমস্ত অন্তর জুড়ে অক্ষয় হয়ে আছে।
মায়ের স্মৃতি : আমার শৈশব স্মৃতির মধ্যে মায়ের স্মৃতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । মাকে আমি ভুলতেই পারি না। মা যে আমাকে কতটা ভালােবাসতেন, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, মা তাঁর জীবনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালােবাসতেন। আমাকে সুখী দেখলে মা খুব খুশি হতেন, আমি একটু অসুস্থ হলে মা অস্থির হয়ে যেতেন। স্কুল বা অন্য কোথাও থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে মা উদ্বিগ্ন চিত্তে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। মায়ের মধুময় স্মৃতি মনে হলে আমার পক্ষে নিজেকে সামলানাে কষ্ট হয়। মনে পড়ে যায় সেই বিখ্যাত গানটি—
মধুর আমার মায়ের হাসি চাদের মুখে ঝরে।
মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।
মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।
লেখাপড়ার স্মৃতি : শৈশবে আমি দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম । হইচই করে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম। একদিন বাবা বললেন, তােমাকে কাল থেকে পড়া শুরু করতে হবে । পরদিন নতুন জামা-কাপড় পরে, নতুন বই-খাতা-কলম নিয়ে বাবার সাথে পড়ার ঘরে গেলাম। বাবা শিক্ষককে সালাম দিতে বললেন— আমি সালাম দিলাম। শিক্ষক হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দিলেন এবং আমাকে আদর করে কাছে বসালেন। তারপর যত্নের সাথে বই খুলে পড়া বলে দিলেন- অ, আ, ই, ঈ। আমি মনােযােগ দিয়ে সেদিন দীর্ঘ সময় পড়েছিলাম । তারপর শুরু হলাে স্কুলে যাওয়ার পালা। পাঁচ বছর বয়সে আমাকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করানাে হয় । বাড়ি থেকে স্কুল খুব দূরে ছিল না। হেঁটেই স্কুলে যেতে হতাে সমবয়সিদের সাথে স্কুলে যেতাম, ভালােই লাগত। এভাবে স্কুলে যাওয়া-আসা, শিক্ষকগণের আদর-স্নেহ-শাসন আর বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা-খুনসুটির মধ্য দিয়ে আমার শৈশবের স্কুল জীবনের দিনগুলাে বিশিষ্টতা লাভ করেছিল ।
বৃষ্টির দিনের স্মৃতি : বৃষ্টি হলে স্কুলে যেতে হতাে না। সেদিন আমার কী আনন্দ! ভাই-বােনেরা মিলে বারান্দায় নেচে গেয়ে বৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতাম। মায়ের বকুনি, বাবার শাসন কিন্তু কে শুনে কার কথা। হৈ-হুল্লোড় করে বাড়ি মাতিয়ে তুলতাম । কখনাে আবার বৃষ্টির তালে তালে সুর করে গান ধরতাম—
মেঘের কোলে রােদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।
স্কুল পালানাের স্মৃতি: ছােটোবেলায় আমি যে কতবার স্কুল পালিয়েছি তার হিসাব নেই । আজ স্কুলে যাব না, একথা বললেই মা ক্ষেপে যেতেন। তাই পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা এসব অজুহাত দেখিয়ে স্কুল কামাই করতাম । আবার বেশিরভাগ সময় বাড়ি থেকে বইপত্র নিয়ে বের হতাম কিন্তু স্কুলে যেতাম না। বইপত্র কোথাও লুকিয়ে রেখে বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম ও খেলাধুলা করতাম । দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলে বাড়িতে ফিরতাম । স্কুলের শিক্ষকরা মাঝে মাঝে বাড়িতে অভিযোগ জানাতেন । আর তখন সবার বকুনি শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত ।
পাড়া বেড়ানাের স্মৃতি : আমি প্রায়ই বন্ধুদের সাথে বাইরে বেড়াতাম । তাদের নিয়ে এ পাড়া, ও পাড়া ঘুরে বেড়াতাম । পুকুরে, জলাশয়ে সাঁতার কাটতাম । কে কত ডুব দিতে পারে, কে কতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে তার প্রতিযােগিতায় নামতাম । বিকেলে ফুটবল খেলতে মাঠে যেতাম। হা-ডু-ডু খেলা, গাছে চড়া ইত্যাদি কাজ আমার প্রিয় ছিল। গাছে চড়ে আম পাড়া, জাম খেয়ে মুখ রঙিন করা আমাদের কাছে খুব মজার ব্যাপার ছিল। আজ যখন কালেভদ্রে অবসর-অবকাশে হারানাে শৈশব খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায় নজরুলের ‘লিচু চোর' পড়ি—
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে।
সেকি বাস করলে তাড়া
বলি থাম্ একটু দাঁড়া!
হাবুদের ডাল-কুকুরে।
সেকি বাস করলে তাড়া
বলি থাম্ একটু দাঁড়া!
তখন লিচু চোরের সাথে আমার শৈশবের অনেক সামঞ্জস্য দেখে বড়ােই পুলকিত হই।
মামা বাড়ির স্মৃতি : শৈশবের আর একটি স্মৃতি আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দেয় । তা হচ্ছে মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া । মায়ের সাথে মামার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমরা নৌকা করে যেতাম । মাঠের বুক চিরে জলের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে যাওয়া সে কী আনন্দ! যখন মামার বাড়ি পৌঁছতাম, তখন নানি আমাদের কত আদর করতেন, নাড়ু, চিড়া, মুড়ি, পিঠা ইত্যাদি খেতে দিতেন । বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে মামার দেশে কালবৈশাখীর ঝড় কিংবা কাঠফাটা রােদে আমাদের দুরন্তপনার স্মৃতি আমাকে আজও উন্মনা করে দেয় । কবির ভাষায়—
ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ ।
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ ।
সেখানকার দিনগুলােতে অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করতাম । জীবনে যে এত হাসি, এত আনন্দ আছে তা মামার বাড়িতেই উপলব্ধি করতাম ।
বন্ধুর স্মৃতি : শৈশব কালের আর একটি স্মৃতি আমাকে এখনও বেদনা দেয়। আমার বন্ধু ছিল সােহেল। একদিন তার ভীষণ জ্বর হলাে। খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি সে বিছানায় ছটফট করছে, তার মা-বাবা কাঁদছে। আমি তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম সােহেল তাের কেমন লাগছে? সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল— আমার ছুটি হয়েছে, তােরা সুখে থাক, আমি চললাম। দেখতে দেখতে সে চলেই গেল। সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম প্রিয়জন হারানাের বেদনা যে কত নির্মম, কত বেদনাময়!
উপসংহার : আজ শৈশবের কত কথাই মনে পড়ছে । দিন আসে দিন যায় । কত স্মৃতি এসে জীবনের পাতায় জমা হয় । কিন্তু শৈশবের সেই সােনাঝরা স্মৃতি কোনােভাবেই ভুলতে পারি না। অনেক সময়ই ভাবি, শৈশবের দিনগুলাে যদি আবার ফিরে পেতাম। কিন্তু তা তাে কখনাে সম্ভব নয় । তাইতাে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ন্যায় আমারও বলতে ইচ্ছে হয়—
দিনগুলাে মাের সােনার খাঁচায় রইল না, রইল না ।
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলাে ।
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলাে ।