বাংলা রচনা : আধুনিক সভ্যতায় বিদ্যুতের ভূমিকা
[ সংকেত: ভূমিকা; বিদ্যুতের আবিষ্কার ও প্রসার; বিদ্যুতের ব্যবহার; আধুনিক জীবনের রসদ বিদ্যুৎ; বিদ্যুৎ ও আধুনিক সভ্যতা; চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অবদান; কৃষি ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুতের অবদান; যােগাযােগ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ; বেকারত্ব লাঘবে বিদ্যুৎ; অপকার; উপসংহার। ]
ভূমিকা : বিজ্ঞানের শত আবিষ্কারের মধ্যে বিস্ময়কর আবিষ্কার হলাে বিদ্যুৎ। সভ্যতার বিকাশে বিদ্যুতের ব্যবহার মানব জীবনের বড়াে কৃতিত্ব। প্রাত্যহিক জীবনে এর বহুমুখী ব্যবহার অপরিহার্য। সময় ও পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলেই শক্তির প্রয়ােজন হয়। এ শক্তিই আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গীভূত। আর বিদ্যুৎ থেকেই আমরা পেয়েছি সব শক্তি। যেকোনাে উৎপাদনমূলক কাজে বিদ্যুতের ব্যবহার আবশ্যক। বিদ্যুৎ আজ মানুষের হাতে বন্দি। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর মাইকেল ফ্যারাডে তার মত পেশ করে বলেছিলেন, 'Electricity is itself a great power that could easily vibrate the whole universe.'
বিদ্যুতের আবিষ্কার ও প্রসার : ‘Electricity’শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকেই এসেছে এর অর্থ ‘পীতাভ তৈল’ নামটি দেন উইলিয়াম গিলবার । আধুনিক ইলেকট্রন অনুসারে জড় পদার্থের বৈশিষ্ট্য মূলত ইলেকট্রিক্যাল বা বৈদ্যুতিক । পদার্থের মূল একক নেগেটিভ চার্জ, ইলেকট্রন পজেটিভ চার্জ, নিউট্রন চার্জ সমন্বয়ে গঠিত। মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। কোনাে বস্তুকে বৈদ্যুতিক চার্জপ্রাপ্ত বস্তুর কাছে নেওয়া হলে এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কাঁচদণ্ডকে রেশম দ্বারা ঘর্ষণ করলে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। জ্বালানিকে পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় । আজকের দিনে পানি বিদ্যুৎ কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আরও নতুন পদ্ধতি হলাে গ্যাসটারবাইন ও নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর এর সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন। গ্যালভ্যানােমিটার দ্বারা বিদ্যুৎ প্রবাহের শক্তি ও তীব্রতা পরিমাপ করা যায়।ইলেকট্রনিক মােটর দ্বারা বৈদ্যুতিক তেজকে যান্ত্রিক তেজে রূপান্তরিত করা হয়।
বিদ্যুতের ব্যবহার : যে যন্ত্রদানবের সহায়তায় গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতা তার সিংহভাগই ব্যবহার করছে বিদ্যুতের শক্তি। বড়াে বড়াে কলকারখানা থেকে শুরু করে আকাশ-বাতাস-অন্তরিক্ষে চলমান সকল যন্ত্রই বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা পেট্রোল, ডিজেল বা যেসব জ্বালানি ব্যবহার করে গাড়ি কিংবা যন্ত্রপাতি চালনা করছি সেসব দ্বারা তৈরি হয় বিদ্যুৎ। কাজেই বিদ্যুৎ ছাড়া সভ্যতার চাকা অচল।
আধুনিক জীবনের রসদ বিদ্যুৎ : আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বাধিক। একটি গৃহে যে সকল সামগ্রী দ্বারা আধুনিক জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে তার সবগুলােই বিদ্যুতের দ্বারা চলে । ইলেকট্রিক হিটার, ফ্যান, ফ্রিজসহ সকল প্রকার। নিত্য ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি আমাদের জীবনে আরাম-আয়েশ এবং প্রশান্তি বর্ধক। বিদ্যুৎ শুধু সবকিছু দ্রুত সমাধান করেই ক্ষান্ত হয়নি এর বদৌলতে আমরা সময়ের অপচয় রােধ করতে পারছি। বিদ্যুৎ বিভিন্নভাবেই উৎপাদিত হতে পারে। তাই বিদ্যুতের অসুবিধা হলে। জেনারেটরের সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়েও কাজের গতি অব্যাহত রাখা হয়।
বিদ্যুৎ ও আধুনিক সভ্যতা : প্রাচীনকালের অন্ধকার জগতের অসভ্য মানুষ ক্রমান্বয়ে সভ্যতার জগতে পদার্পণ করেছে, পেয়েছে। আলাে ঝলমলে জীবনের সন্ধান। এই আলােকদীপ্ত সভ্যতা বিজ্ঞানের দান । এই সভ্যতার চালিকাশক্তি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার বিদ্যুৎ। আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ ছাড়া এই যুগের মানুষের জীবন অচল। ঘরে আলাে জ্বালানাে থেকে শুরু করে পাখার বাতাস, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি চালানাে সকল কাজে বিদ্যুতের অবদান অনস্বীকার্য। জীবনের প্রয়ােজনে আজকাল প্রায় সকল কাজই বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। তাই বলা যায়, আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুৎ নির্ভর সভ্যতা। এ যুগের মানুষ দৈনিক ২৪ ঘণ্টা সময় কেউ না কেউ কোনাে না কোনােভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে । আজকাল লােডশেডিং-এর প্রকোপ থেকে আপদকালীন সময়ে রেহাই পাওয়ার জন্য গৃহে চার্জার ব্যবহার করা হচ্ছে। এ চার্জার বিদ্যুতের সাহায্যেই চার্জ করে রাখা হয়। কাজেই এসব কিছু বিবেচনা করলে আমাদের আর কোনাে সন্দেহ থাকে না যে আধুনিক জীবন ব্যবস্থা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অবদান : আধুনিক চিকিৎসায় বিদ্যুতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । বিদ্যুৎ ছাড়া উন্নত চিকিৎসা মােটেই সম্ভব নয়। মানুষের দেহের ভিতরের রােগ নির্ণয়ের জন্য এক্সরে বা রঞ্জনরশ্মি, ইসিজি, আলট্রাসনােগ্রাফ প্রভৃতি আবিষ্কার করা হয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এসব যন্ত্র চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। তাছাড়া বিদ্যুতের সাহায্যে ক্যানসারের থেরাপি দেওয়া হয়।
কৃষি ও শিল্প কারখানায় বিদ্যুতের অবদান : আধুনিক যুগের প্রতিটি কাজে বিদ্যুতের অবদান রয়েছে। শিল্প কলকারখানার চাকা ঘােরে বৈদ্যুতিক টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ ছাড়া কারখানা অচল। আর্থনীতিক উন্নয়নের পথ বন্ধ । আজকাল কৃষি কাজেও বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে । বিদ্যুতের মাধ্যমে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে এতে অনাবৃষ্টিতেও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে না। বিদ্যুৎ কঠিন কাজকে সহজ করে দিয়েছে, অসম্ভবকে করেছে সম্ভব।
যােগাযােগ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ : উন্নত বিশ্বে যােগাযােগ ব্যবস্থাকে সহজ করে দিয়েছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের সাহায্যে বিভিন্ন যানবাহন চলছে। ভারী জিনিস তুলতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রেন, উঁচু ভবনে উঠা-নামা করতে যে লিফট ব্যবহার করা হচ্ছে তা বিদ্যুতের সাহায্যে চলছে। তাছাড়া ইন্টারনেট, ই-মেইল, টেলিফোন, টেলিভিশন, মােবাইল, কম্পিউটারসহ আরও অনেক যন্ত্র বিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে চলছে।
বেকারত্ব লাঘবে বিদ্যুৎ : বিদ্যুৎ শুধু মানুষের কাজে লাগে না, বরং মানুষকেও বিদ্যুতের কাজে লাগানাে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেক লােক প্রয়ােজন হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক টাকা বিনিয়ােগ করে এবং বিদ্যুতের লাইন লাগানাে ও বিল আদায়ের জন্য অনেক শ্রমিককে কাজে লাগানাে হয়। ফলে বেকার লােকের কর্মসংস্থান হয় এতে বেকারত্ব কমে।
অপকার : মানুষের কল্যাণের জন্যই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় । কিন্তু অযত্ন ও অবহেলার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার উল্টো হলে তাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। প্রতি বছর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সবারই স্মরণ রাখা উচিত যে, আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুতের ওপর ভর করে গড়ে ওঠলেও আধুনিক মানুষ বিদ্যুৎকে নিজেদের কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত্নবান, সতর্ক ও সুশীল হয়ে উঠতে পারেনি। বিদ্যুৎকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে তা অবশ্যই কল্যাণ নিয়ে আসে। তবে বিদ্যুতের অসতর্ক ব্যবহার মহা মূল্যবান প্রাণ ও সম্পদহানির কারণ হতে পারে ।
উপসংহার : বর্তমান পৃথিবীর মানুষ বিদ্যুৎনির্ভর হয়ে পড়েছে । তারা বিদ্যুৎ ছাড়া সামান্য কাজ করতে চায় না। বিদ্যুৎ মানুষের জীবনকে সহজ ও বর্ণাঢ্য করে দিয়েছে। এতে সময় ও শ্রম দুটোই লাঘব হয়েছে। বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে উঠছে। মােটকথা, বিদ্যুৎ আমাদের আধুনিক জীবনের এক আবশ্যকীয় উপকরণ বটে এর ব্যবহার বহুমুখী। সভ্যতা বিনির্মাণের এ অপরিহার্য উপাদানের ব্যবহারে আমাদের যথেষ্ট সাশ্রয়ী হতে হবে। বৈদ্যুতিক লাইন ও স্থাপনা সংরক্ষণে আমাদের যত্নবান ও দায়িত্ববান হয়ে উঠতে হবে ।