|
অভিজ্ঞতা বর্ণনা : লালবাগ কেল্লায় একদিন |
লালবাগ কেল্লায় একদিন
বাংলাদেশ ইতিহাস আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এর নানা স্থানে নানা ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শন সকলকে আকৃষ্ট করে। বেশ কিছুদিন ধরেই সাব্বির প্রস্তাব করেছিল। এবার আর বইয়ের পাতায় নয় বরং নিজ চোখে দেখব কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী থেকে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে । আমরা ঢাকা পৌছলাম রাতে । পরের দিন সকালে গেলাম ঢাকার লালবাগের রিয়াজউদ্দিন রােডে লালবাগ কেল্লায় । নিয়মানুযায়ী টিকিট নিয়ে কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলাম ।। আমাদের প্রথমেই আকৃষ্ট করল লালবাগ কেল্লার বিশাল তােরণ বা ফটক। এ কেল্লার ফটকের সংখ্যা তিনটি। একটি ছাড়া অন্য দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে প্রবেশমাত্রই চোখ জুড়িয়ে যায় বাগানটির অপূর্ব দৃশ্যাবলি দেখে । আরও একটু অগ্রসর হলেই পাওয়া যায়, ইতিহাসখ্যাত শায়েস্তাখানের প্রিয় দুহিতা পরীবিবির সমাধিসৌধ । পরীবিবি কত সালে মৃত্যুবরণ করেন তার কোনাে পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে অনেকে অনুমান করেন, তিনি ১৬৮৭-৮৮ খ্রিষ্টাব্দের কোনাে একসময় দেহান্তরিত হন । স্বভাবতই প্রিয়। কন্যার এই অকালমৃত্যু শায়েস্তা খানকে দারুণভাবে মর্মাহত করে। তাই কন্যার স্মৃতি চিরস্মরণীয় করার জন্য শায়েস্তা খান বহু। অর্থ-কড়ি ব্যয় করে এ সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন; যা এক অপূর্ব নয়নাভিরাম ইমারত হিসেবে পরিচিত । অসংখ্য মূল্যবান মার্বেল পাথর, কষ্টিপাথর ও নানারকমের ফুল-লতা-পাতা শােভিত টালি দ্বারা ইমারতটি অলংকৃত। এর অভ্যন্তরে যে নয়টি কক্ষ রয়েছে, তাতেও বৈচিত্র্য রয়েছে । কক্ষগুলাের ওপরের অংশটুকু গম্বুজাকৃতি এবং কষ্টিপাথরে শােভিত । সমাধিসৌধের মূল গম্বুজটি দামি তামার পাত দ্বারা মােড়ানাে। এছাড়াও রয়েছে আরও সমাধি, ফোয়ারা, পাহাড়ের মতাে উঁচু টিলা এবং সুড়ঙ্গপথ; আবার কেল্লার দক্ষিণপশ্চিমে রয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্বে তােপমঞ্চ.। কেল্লার পূর্ব প্রান্তে রয়েছে একটি পুকুর। পুকুরের চারদিক ঘাট বাঁধানাে এবং চমৎকার সিড়ির ব্যবস্থাও রয়েছে। এর একেবারেই পেছনে রয়েছে তকালীন সৈনিক ব্যারাক; অধুনা এটি আনসার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে লালবাগ কেল্লা মসজিদ। এটি সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আযম বাংলার সুবেদারকালীন নির্মিত হয়েছে। মসজিদটি আয়তাকার এবং তিন গম্বুজবিশিষ্ট । মসজিদটি স্থাপত্যে মােগল যুগের দৃষ্টান্ত ধারণ করে আছে। আরও আকর্ষণীয় হচ্ছে সুবেদার শায়েস্তা খানের বাসভবন এবং তাঁর দরবার মহল। এ সময়ে ব্যবহৃত মানচিত্র, তৈজসপত্র, সুরাহি ও শিলা পাথর । এছাড়াও রয়েছে বর্শামূল, বর্শাফলক, লােহার জালের বর্ম, ছােরা ও খাপ, তীর, বর্শা, গুপ্তি, তীর ও বর্শা নিরােধক লােহার জালের পাত্র, ঢাল, তরবারি, দস্তানা, পারকাশন লক বন্দুক, রাইফেল, সৈনিকদের ব্যবহৃত পােশাক, রাজপােশাক ইত্যাদি; যা স্পষ্টত ১৭/১৮ শতকের নিদর্শন বহন করছে। আরও রয়েছে ১৭ শতকের পারস্যে তৈরি বিখ্যাত কার্পেট, ঝাড়বাতি, ল্যাম্প, জায়নামাজ এবং আওরঙ্গজেবের শাসনামলের মসজিদ ও বাগান তৈরির বিবরণ সংবলিত শিলালিপি । এতে দেখা যায়, শিলালিপিগুলাে ১০৯৯ হিজরি এবং ১৬৮৯-৯০ খ্রিষ্টাব্দ সময়ের । এছাড়াও দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দুরদানার প্রতিকৃতি, সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার প্রতিকৃতি, শাহজাদা আযম শাহের প্রতিকৃতি, সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের প্রতিকৃতি, আসফ শাহ বাহাদুরের প্রতিকৃতি, মধুমতি অঙ্কিত চিত্র, যুবরাজ ও রাজ তনয়ার অশ্বচালনা । সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দিত হচ্ছে বৃক্ষছায়ায় চিন্তামগ্ন খাজা হাফিজ সিরাজের প্রতিকৃতি। সত্যি যেন ইতিহাসের হাজার বছরের পথ পেরিয়ে এই লালবাগ কেল্লায় পৌঁছেছি। ওদিকে সময় যে কীভাবে চলে গেল— তাই বিদায় নিতেই হয়।