বাংলা রচনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের রাজনীতি
বাংলা রচনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের রাজনীতি |
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের রাজনীতি
অথবা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশের রাজনীতি
অথবা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
[সংকেত : ভূমিকা; মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট; মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপপ্রয়ােগ; আমাদের প্রত্যাশিত রাজনীতি; উপসংহার। ]
ভূমিকা : দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিল । তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরকাল অটুট থাকবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ছেচল্লিশ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক সরকারের কার্যকারিতার তেমন একটা বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ করা যায় না। বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বর্তমান রাজনীতিবিদরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন । আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন, সেই চেতনাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এখনকার রাজনীতি যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে, তাতে কারও কোনাে সন্দেহ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তান লাভ করে । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের দুঃশাসন, শােষণ ও বঞ্চনার মাধ্যমে এদেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করে। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নেয়নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তারা তাদের জাতীয়তাবাদের প্রথম বিজয় সূচনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন ও ৬৬'র ছয়দফা আন্দোলন হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফা স্বাধিকার দাবির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ বিপুল ভােটে জয়লাভ করে । বাংলার মানুষের এই বিজয়কে কেন্দ্রীয় সরকার নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপস আলােচনার নামে প্রহসন চালায়। বাঙালি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষের দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্নকে নস্যাৎ করার জন্য পাক হানাদার বাহিনী মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় ঢাকার বুকে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নির্মম হত্যাকাণ্ড। বাঙালিরাও তাদের প্রতিহত করার জন্য নেমে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে । দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় ।
মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালােরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালায়। তাদের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এদেশের মানুষ যুদ্ধে নামে। শত্রুমুক্ত স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সেদিন মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। একটি শােষণমুক্ত স্বাধীন, উদার-গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সেদিন বাঙালিরা যুদ্ধ করেছিল ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : দুই লক্ষ মা-বােনের ইজ্জত আর ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির এই কাঙিক্ষত স্বাধীনতা তাদের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে। তা আমরা তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের একটি বেতার ভাষণ থেকে উপলব্ধি করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, “আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। সেসব শহিদদের কথা, সেসব অসীম সাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধাদের, যারা তাদের আত্মবলিদানের জন্য অমর হয়েছেন, তারাই আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন চিরকাল । সত্যিই বাঙালি এ চেতনাকে লালন করে এসেছিল । কিন্তু পঁচাত্তরে রাষ্ট্র ক্ষমতা সামরিক জান্তার করায়ত্ত হওয়ার পর থেকে এ চেতনার অবসান ঘটতে থাকে । এত কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্যকে বাঙালি আজ ধরে রাখতে পারেনি। স্বাধীনতা লাভের ছেচল্লিশ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই না। জাতি আজ ভুলে যেতে বসেছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাস । জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ শুধু মিথ্যা আর প্রবঞ্চনার ছড়াছড়ি। জাতির বিবেক যেন আজ শুধু নিষ্পেষিত। মানবিক মূল্যবােধ ও নৈতিকতা হতে চলেছে বিলুপ্ত । মানুষের মানঅপমানবােধ ও মনুষ্যত্ব বলতে আজ আর কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি? আমরা সবাই যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে লালন করতাম তাহলে আজ এ পরিস্থিতি চোখে দেখতে হতাে না। তাহলে আমরা কোনােভাবেই ভুলে যেতে পারতাম না অগণিত মানুষের আত্মদানের কথা। দীর্ঘকাল তারা নানা অত্যাচার-অবিচার সহ্য করে যে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন তা আমরা মূল্যায়ন করতাম। আমাদের কাজকর্ম ও আচরণ দেখে মনে হয় না আমরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ রেখেছি। ভবিষ্যৎ প্রজনাের মাঝেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে পারিনি। আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ এ হাতহাস জানলেও অদূর ভবিষ্যতে প্রায় সবাই তা ভুলে যাবে। কেননা আজকের পরিস্থিতিতেই লক্ষ করা যাচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সকলের মধ্যে প্রায় স্তিমিত । আগামী এক যুগ পরে কেমন হবে তা কল্পনাতীত নয় ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মক্তিযুদ্ধের চেতনা : স্বাধীনতার পর্বে বাংলাদেশের রাজনীতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি খুব কঠিন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শােষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ বাংলার মানুষ নানাভাবে সুবিধাবঞ্চিত হয়েছে। তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে এদেশের মানুষ। তাই বিভিন্ন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অবশেষে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় অর্জন এবং একটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পরিবেশ গঠন । এ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে পড়েছিল। এ সংগ্রামের বিরুদ্ধে যেসব দেশি-বিদেশি অপশক্তি বাধা। হয়ে দাড়িয়েছে তাদের প্রতিহত করার জন্য বাঙালি আরও দ্বিগুণ উৎসাহে সংগ্রাম করেছে। বাঙালি জাতির রাজনীতিক চেতনা তখন আরও রুদ্ররূপ ধারণ করে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সকল অপশক্তির অবসান ঘটে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও সেই অপশক্তি আমাদের রাজনীতিক চেতনায় আবার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে । কীভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিক অঙ্গন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নির্বাসনে পাঠানাে যায়, রাজনীতিবিদদের বিপথগামী করা যায় এ চেষ্টায় তারা সদা লিপ্ত থাকে। সেই অপশক্তি একসময় সফল হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে আসে। আমাদের রাজনীতি। তাদের প্রভাবে এদেশের রাজনীতি কলুষিত হয়ে একের পর এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হতে থাকে। রাজনীতি থেকে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবােধ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মােটকথা, স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে আমাদের রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলীন হয়ে যায় ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপপ্রয়ােগ : স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের রাজনীতি থেকে অপসারিত হতে থাকে। আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফাটল ধরানাের চেষ্টা করে স্বাধীনতা বিরােধী অপশক্তি। আবার এদেশে পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক শাসন কায়েম করার জন্য অনেকেই তৎপর হয়ে ওঠে। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষমতার লােভ তাদের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধ চেতনা ছিল তা বর্তমানে বিদ্যমান নেই । মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে ও ক্ষমতার লােভে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু মুখে প্রকাশ করছে । জাতীয় জীবনের সর্বত্র চলছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপপ্রয়ােগের খেলা। রাজনীতিক দলগুলাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তাদের ক্ষমতা। লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করছে মাত্র । ফলে সর্বত্র ঝগড়া-বিবাদ, হানাহানি, খুন, গুম প্রভৃতি চলছেই । প্রতিদিন পত্রিকার পাতা ও টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই আমরা দেখতে পাই কত মানুষ এখনও নির্মম অত্যাচারের শিকার হচ্ছে । কতজন মূল্যবান জীবন হারাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু রাজনীতিকদের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে, মনে ও মগজে একটুও নেই। তার বাস্তব কোথাও প্রয়ােগ ঘটেনি।
আমাদের প্রত্যাশিত রাজনীতি : বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে যে রাজনীতি বিদ্যমান তা আমাদের প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাই সেই রাজনীতি, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করবে । যে কাক্ষিত রাজনীতির জন্য আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সে রাজনীতি আমাদের স্বপ্নই থেকে গেল । সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা চালু থাকার কথা। কিন্তু এদেশে গণতন্ত্র কি পুরােপুরি কার্যকর? আবার ক্ষমতাশালী রাজনীতিক দলগুলাের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই অগণতান্ত্রিক কাজে লিপ্ত থাকে। ছােটোখাটো কিছু রাজনীতিক দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইলেও তারা কখনাে তা পারবে না। কারণ সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে তারা কখনােই ক্ষমতায় আসতে পারেনি ও পারবে বলেও মনে হয় না। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী বেশকিছু লােক আমাদের রাজনীতিক অঙ্গনে বেশ জোরালাে স্থান করে নিয়েছে। এটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। ও কলঙ্কিত অধ্যায়। তবে বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মুক্তিযােদ্ধাদের নানা সুযােগ-সুবিধা প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন ঘটানাের চেষ্টা করছেন। তবে শুধু তার বাস্তবায়ন ঘটালেই হবে না জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা, মানুষের আর্থনীতিক মুক্তি, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে। সফলতা অর্জন করতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সফল বাস্তবায়ন ঘটবে । তাহলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত রাজনীতি ফিরে পেতে পারব।
উপসংহার : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই আমাদের রাজনীতি উৎসারিত। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরেই এদেশের রাজনীতিক কাঠামাে গড়ে উঠেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলােকে আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও তা আজ সেই চেতনা থেকে বিচ্যুত । এদেশের দূষিত রাজনীতির কারণে প্রতি পদে পদে মানুষকে দুর্বিপাকে পড়তে হচ্ছে।