বাংলা রচনা : বাংলাদেশের বন্যা
বাংলাদেশের বন্যা |
বাংলাদেশের বন্যা
[ সংকেত : ভূমিকা; বন্যায় দুর্ভোগ; বন্যার কারণ; বন্যা নিরােধের উপায় বা ব্যবস্থা; উপসংহার। ]ভূমিকা : বৃষ্টিপাত প্রধান মৌসুমি অঞ্চলে অবস্থিত আমাদের এই নদীবহুল বাংলাদেশ। হিমালয়ের বরফগলা পানিতে বাংলাদেশের বড়াে বড়াে নদী সারা বছরই প্রায় পূর্ণ থাকে। বর্ষা ঋতুতে যখন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ সমগ্র দেশের উপর দিয়ে বয়ে যায় এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তখন নদীগুলাে ক্রমশ ভরে উঠতে থাকে। কোনাে কোনাে বছর বৃষ্টিপাতের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে যায় এবং তখনই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে পানিতে নদীর দুকূল ছাপিয়ে সমস্ত দৈশ প্লাবিত হয়ে যায় এবং এই পানি যখন ক্রমশ বিপদসীমার উপরে উঠে গিয়ে গ্রাম, গঞ্জ, শহর প্লাবিত করে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে তখনই তাকে আমরা বন্যা বলি ।
বন্যায় দুর্ভোগ : বন্যা বাংলাদেশের একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কৃষকের জন্য এক মহা-অভিশাপ । এই ভয়াবহ বন্যা প্রায় প্রতি বছরই মানুষের বাড়ি-ঘর, ফসলের মাঠ ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেয়। গবাদিপশু এমনকি মানুষ পর্যন্ত রেহাই পায় না মৃত্যুর হাত থেকে। যারা বেঁচে থাকে তাদের জীবনেও নেমে আসে ভয়াবহ দুঃখের কালােরাত্রি । বিগত ১৯৫০ সাল থেকে বন্যা বাংলাদেশের একটি প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। ১৯৫০ থেকে শুরু করে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৮, ১৯৬৪, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৮৮ এবং সম্প্রতি অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের বন্যা মানুষের জীবনে এক মহা-অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ লােক বন্যায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অসংখ্য গবাদিপশু ও মানুষ প্রাণ হারায়। দেশের সর্বত্র বিরাজ করতে থাকে। নৈরাজ্য ও হাহাকার। বহু আশার সােনালি ফসল সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়ে, গােরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি হয়ে পড়ে আশ্রয়হীন। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষেরা হয়ে পড়ে বেকার । আর তাই খাদ্যাভাবে অনেকের জীবনে নেমে আসে মৃত্যুর অমানিশা। আর যারা বেঁচে থাকে তারা অস্থিচর্মসার দেহ নিয়ে কোনাে রকমে প্রাণে রক্ষা পায়। বন্যার সময়ে সাপে মানুষে এক সঙ্গেও বাস করতে দেখা যায়। এতে সর্পদংশনেও অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। নিচু স্থানের অধিবাসীরা উঁচু রাস্তায় বা রেললাইনে অথবা নিকটবর্তী শহর, বন্দরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের উপর তলায় আশ্রয় নেয়। এসব আশ্রয় শিবিরে সরকারি-বেসরকারি বা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করলেও প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাও ভাত নয়, চিড়ে-মুড়ি কিংবা খিচুড়ি । ভালাে খাদ্যের অভাবে কত অখাদ্য পর্যন্ত খেতে হয়। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির অভাবে পান করতে হয় ময়লাযুক্ত পানি। ফলে মহামারি আকারে দেখা দেয় ডায়রিয়া, আমাশয় জাতীয় মারাত্মক ব্যাধি। শুরু হয় মরণের খেলা। বিগত ১৯৮৮ সালের বন্যায়। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৬০৩ জন। অনাহারে এবং ডায়রিয়ায় আরও বেশ কজন মারা গেছে, সে হিসাব সরকারি সূত্র দেননি। তাছাড়া বন্যা পরবর্তী মহামারিতে আরও অনেক লােক মারা গেছে । এমতাবস্থায় মরাকান্নায় এবং মরণের ভয়ে কান্নায় সমগ্র দেশ যেন থরথর করে কাঁপতে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শুনতে থাকে বন্যা পরবর্তী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। সর্বনাশা বন্যায় সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এই রূপসি বাংলা পরিণত হয় দুর্ভিক্ষের অঞ্চলে । সরকারের কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা। থেকে শুরু করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ হয় ব্যাহত । দেশের আপামর জনগণকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করাই সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে হাত পাততে হয় বিদেশের কাছে। প্রতি বছর হাত পাততে যেয়ে আমরা বিদেশের কাছে হচ্ছি হেয়, পরিচিত হচ্ছি ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে।
বন্যার কারণ : বন্যার কতগুলাে কারণ প্রাকৃতিক । প্রথমত, অধিক বৃষ্টিপাত; দ্বিতীয়ত, হিমালয়ের বরফগলা পানি নিমভূমির দিকে ধাবিত হয়ে নদীর পানির সাথে মিশে। ফলে প্রবল পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ বন্যার আকার ধারণ করে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, প্রবল ভূমিকম্প বাংলাদেশের বন্যার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ আমাদের বিগত ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলাের তলদেশ অনেকখানি উঁচু হয়ে যাওয়ায় এদের পানিধারণ ক্ষমতা কম । এছাড়া বহু বছর যাবৎ নদীগর্ভে কোনাে সংস্কার সাধিত না হওয়ার ফলেও নদীর তলদেশ ভরাট হতে চলেছে। অন্যদিকে, নদীর অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব।
বন্যা নিরােধের উপায় বা ব্যবস্থা : বন্যার কারণগুলাে যেহেতু নৈসর্গিক তাই এগুলাে সরাসরি দূর করা সম্ভব নয়। তবে এই বিজ্ঞানের যুগে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্যা প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলা মােটেই অসম্ভব কিছু নয়। এজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এসব ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পগুলাে আমরা Structural measures হিসেবে অভিহিত করতে পারি। যেমন-- (ক) বাধ এবং বন্যা দেওয়াল নির্মাণ; (খ) নদীগর্ভ খনন এবং পানি প্রবাহের কার্যকারিতা বৃদ্ধিকরণ; (গ) খাল ও নালা খননের মাধ্যমে প্রধান নদীর পানির প্রতিসরণ; (ঘ) বিশেষভাবে নির্মিত জলাধারে বন্যার পানি প্রবাহিতকরণ ইত্যাদি। এর ফলে একদিকে যেমন বন্যাকে প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে তেমনি অন্যদিকে শুকনাে মৌসুমে কৃষিযােগ্য ভূমিতে প্রয়ােজনীয় পানি সেচের মাধ্যমে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এছাড়া এই সঞ্চিত পানি থেকে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও সম্ভব হবে।
উপসংহার : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষের শক্তি সীমাবদ্ধ হলেও এই বিজ্ঞানের যুগে দৈবের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকা বােকামি ছাড়া কিছুই নয় । পৃথিবীর উন্নত দেশগুলাে বিজ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়ােগে বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশেও তা অবশ্যই সম্ভব। প্রয়ােজনে উন্নত দেশের বড়াে বড়াে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়ে আমাদের কাজে নামতে হবে। তবেই আমাদের দেশ বন্যার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।