বাংলা রচনা : নবান্ন ও বাঙালি সংস্কৃতি
নবান্ন ও বাঙালি সংস্কৃতি |
নবান্ন ও বাঙালি সংস্কৃতি
অথবা, নবান্ন উৎসব ও বাঙালি সংস্কৃতি
[ সংকেত : ভূমিকা; সংস্কৃতি; বাঙালি সংস্কৃতি; বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিচয়; নবান্ন; নবান্ন উৎসব; গ্রামের নবান্ন; বাঙালি সংস্কৃতিতে নবান্ন; উপসংহার । ]ভূমিকা : একটি জাতির আসল পরিচয় পাওয়া যায় তার সংস্কৃতির মাধ্যমে । প্রতিটি জাতিই নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। সংস্কৃতির ভিন্নতার ফলে পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় । সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে বাঙালিরা বেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুতে একেক রকম আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নানা রূপে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য ফুটে ওঠে। এগুলাের মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা উৎসব উল্লেখযােগ্য। বাঙালির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে নবান্ন উৎসব অন্যতম । প্রাচীনকাল থেকে এ উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে আছে।
সংস্কৃতি : সংস্কৃতি হলাে একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয়, সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ । একটি সমাজে সংস্কারের মধ্য দিয়ে যে আচার-অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবৎ পালিত হয়ে আসছে তাই সংস্কৃতি। একটি দেশের লােকাচার বা জাতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে সংস্কৃতি ফুটে ওঠে। তবে সংস্কৃতি একেক অঞ্চল বা গােষ্ঠীভেদে একেক রকম হয়ে থাকে। সবশেষে আমরা বলতে পারি, কোনাে একটি অঞ্চলের জনগােষ্ঠীর দীর্ঘদিন ধরে আচরিত নিজস্ব জীবনপ্রণালিকে সংস্কৃতি বলে ।
বাঙালি সংস্কৃতি : বাঙালি সংস্কৃতি হলাে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান । পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলাের মতাে বাঙালি জাতিরও রয়েছে নিজস্ব সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অনার্যকালে অস্ট্রিক গােষ্ঠীর মানুষেরা বাঙালি সংস্কৃতির ভিত গড়েছিল। তারপর এর সাথে দ্রাবিড় ও অনার্য ব্ৰহ্ম সংস্কৃতির ধারা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতি তিনটি ধারায় পালিত হচ্ছে- (ক) নগর সংস্কৃতি (খ) গ্রাম্য বা লােকসংস্কৃতি এবং (গ) উপজাতীয় সংস্কৃতি। নগরের মানুষের জীবন-জীবিকা, শিক্ষাদীক্ষা, পােশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার, আনন্দ-উৎসব প্রভৃতির সংমিশ্রণে নগর সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এ সংস্কৃতি পালিত হয় খুব জাকজমকভাবে। অপরদিকে, গ্রাম্য সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে গ্রামের বিশাল জনগােষ্ঠীকে নিয়ে। বহুকাল ধরে গ্রামের মানুষের জীবনজীবিকা, চাষাবাদ, খেলাধুলা, পােশাক-পরিচ্ছদ, অন্ন, বিনােদন ইত্যাদির সংমিশ্রণে গ্রাম্য বা লােকসংস্কৃতি পালিত হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে আরেকটি সম্প্রদায় বাঙালি সংস্কৃতি পালন করে। সেই সম্প্রদায় হলাে উপজাতি । তারা তাদের সম্প্রদায় ভিত্তিক নিয়মে বাঙালি সাজে বাঙালির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির পরিচয় : বাংলাদেশের সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে লােকসংস্কৃতি। লােকসংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে রয়েছে লােকসাহিত্য ও গ্রাম্য মানুষের জীবনালেখ্য। যেমন- কালকেতু-ফুল্লরা, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, মেনকা-উমা, মহুয়া-মলুয়া, কাজলরেখা, সােনাই ইত্যাদি। লােক-চরিত্র আমাদের লােকসংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তাছাড়া বাংলাদেশের মানুষের নিজ হাতে তৈরি গৃহনির্মাণ। পদ্ধতি, মৃৎশিল্প, লােকশিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদির মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট পাওয়া যায়। গ্রামবাংলার মেয়েরা ঘরে বসে নকশিকাঁথা, শিকা, মাটির পুতুল, পাটি, কাগজের মােড়াসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে বাংলার সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছে। গ্রাম্য খেলাধুলা, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, বিয়ে অনুষ্ঠান, ফসলবােনা-ফসলকাটা ইত্যাদি বাংলাদেশের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়াে নিদর্শন।
নবান্ন : 'নবান্ন' হলাে সদ্য কাটা নতুন ধানের চাল দিয়ে অন্ন-ব্যঞ্জন করা। নবান্ন বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ লােকজ উৎসব। নবান্নকে সন্ধিবিচ্ছেদ করলে নব + অন্ন দুটি শব্দ পাওয়া যায় । 'নবান্ন' শব্দের অর্থ হলাে নতুন চালের ভাত’ । বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণকেই জীবন-জীবিকার জন্য কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করতে হয়। অগ্রহায়ণ মাসে কৃষকের ঘরে ঘরে ওঠে নতুন ধান । নতুন ফসল ঘরে ওঠায় কৃষকের মুখে হাসি ফোটে । ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠা বানানাের ধুম পড়ে। নতুন ফসল ঘরে তােলার আনন্দে কৃষকেরা নবান্ন উৎসব উদযাপনে মেতে ওঠে। এসময় কৃষক আমন ধান কাটেন । নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে কৃষক সম্পদ অর্জন, অধিক খাদ্যশস্য ও ফসল ফলানাের জন্য যথেষ্ট বৃষ্টি কামনা করেন।
নবান্ন উৎসব : অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটার সময় কৃষকেরা নবান্ন উৎসব পালন করে। নবান্ন উৎসবের দিন ভােরবেলা কৃষকের বাড়ির ছােটো ছােটো ছেলেমেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে আর ছড়া কেটে কেটে দাঁড়কাকদের নিমন্ত্রণ করে।
কো কো কো, মােরগাে বাড়ি শুভ নবান্ন ।
শুভ নবান্ন খাবা কাকবলি লবা ।।
পাতি কাউয়া লাথি খায়।
দাঁড় কাউয়া কলা খায় ।
কো কো কো, মােরগগা বাড়ি শুভ নবান্ন ।
শুভ নবান্ন খাবা কাকবলি লবা ।।
পাতি কাউয়া লাথি খায়।
দাঁড় কাউয়া কলা খায় ।
কো কো কো, মােরগগা বাড়ি শুভ নবান্ন ।
বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নবান্ন উৎসবটি মনেপ্রাণে পালন করে। এদিন তারা নতুন চাল পেঁকিতে কুটে এবং নতুন চাল দিয়ে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করে। তারপর বাড়ির উঠানে গর্ত করে জ্যান্ত কৈ মাছ ও সামান্য দুধ দিয়ে বীরবাশ’ পোঁতা হয়। সেই বাঁশের চারপাশে চালের গুঁড়া দিয়ে আলপনা করে। তারপর কাকবলি’ অনুষ্ঠান শুরু করে। এ অনুষ্ঠানে চালমাখা কলা ও নারকেলের নাড় কাককে খাওয়ানাে হয় । কাকবলি’ অনুষ্ঠান শেষে অন্নদাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা দেওয়া এবং 'নবান্ন' আহার করানাে হয়। তারপর দিনভর আনন্দের মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করা হয় । বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতিরা বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তাদের নিজেদের মতাে করে নবান্ন উৎসব পালন করে । সাওতালরা নবান্নকে ঘিরে ‘সােহরায় উৎসব পালন করে। এ উৎসব সাতদিন যাবৎ চলে । পৌষ মাসে নতুন ফসল ঘরে তুলে গানবাজনা ও মদ্যপানের মধ্য দিয়ে এ উৎসব চলে। ম্রো উপজাতি 'চামেইনাত’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব পালন করে। এ দিন তারা মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাত দিয়ে সবাইকে খাওয়ায়। আর মুসলমানরা সামান্য আয়ােজনের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান। উদযাপন করে। সেদিন তারা শিরনি বেঁধে নিয়া খাওয়া অনুষ্ঠানে সবার জন্য মঙ্গল কামনা করে ।।
গ্রামের নবান্ন : নবান্ন উৎসবটি মূলত গ্রামের লােকসংস্কৃতির অংশ। কেননা কৃষকেরা মূলত গ্রামে বাস করে এবং গ্রামের মাঠে ফসল। ফলায়। নতুন ফসল ঘরে তােলার আনন্দে কৃষকেরা নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। তাই প্রকৃতিগত দিক থেকে নবান্ন উৎসবটি গ্রামেরই একটি অনুষ্ঠান গৃহস্থ পরিবারে সেদিন আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। তাদের ছেলেমেয়েরা নতুন জামা-কাপড় পরে আনন্দে মেতে ভত। আত্মীয়-স্বজনরা নতুন নতুন কাপড় পরে গ্রামে বেড়াতে আসে। আনন্দ-মুখর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে পিঠা-পায়েসের উৎসব শুরু হয় । পাড়ায়-পাড়ায় জারিগান, সারিগান, পালাগান, বাউলগান ও নৃত্যানুষ্ঠান বেশ জমে ওঠে। উৎসবের আমেজে কৃষক হাসিভরা মুখে নবান্ন পালন করে।
বাঙালি সংস্কৃতিতে নবান্ন : বাংলাদেশে প্রধান দুটি সম্প্রদায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করে আসছে। একটি মুসলমান অপরটি হিন্দু। এই দুই সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা ধর্ম এবং যৌথ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ নবান্ন উৎসব— যা হিন্দু-মুসলমানসহ সব ধর্মের লােকেরা পালন করে। এ অনুষ্ঠান পালনে জাতধর্মের কোনাে ভেদাভেদ থাকে না। সুতরাং বলা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নবান্ন উৎসবটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
উপসংহার : বাঙালি সংস্কৃতিমান জাতি। অন্যান্য জাতির সংস্কৃতির মতাে বাঙালি জাতির সংস্কৃতিও বেশ উচু মাপের। সভ্যতার সবচেয়ে বড়াে বাহক সংস্কৃতি। একটি জাতির সভ্যতা ও উৎকর্ষ পরিমাপ করার জন্য প্রয়ােজন সেই জাতির সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা । কেননা একটি জাতির সংস্কৃতির মধ্যে তাদের সভ্যতা ও উৎকর্ষ বিরাজ করে। বাঙালি জাতির সংস্কৃতিও তেমনি। বাঙালি সংস্কৃতির। একটি নন্দিত অংশ ‘নবান্ন উৎসব’– যা আবহমানকাল ধরে বাঙালি কৃষকেরা পালন করে আসছে। ভবিষ্যতেও নবান্ন উৎসব’ পালনের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে।