বাংলা রচনা : একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকাহিনী
বাংলা রচনা : একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকাহিনী |
একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মকাহিনী
আমি মুক্তিযােদ্ধা আকরাম হােসেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমিও সকলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলাম ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে । আমার বাড়ি বরিশাল । কিন্তু আমি সাতক্ষীরা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সেই সুবাদে সাতক্ষীরার অনেক অঞ্চল আমার পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই বিভীষিকাময় দিনগুলাে আজও আমার মনকে আলােড়িত করে তােলে। সে স্মৃতি আমার কাছে চির অমলিন হয়ে থাকবে । মা-বাবার একমাত্র ছেলে আমি, বাবা-মায়ের চোখের মণি । একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বয়স বত্রিশ বছর । তখন আমি বিবাহিত এবং আড়াই বছর ও এক বছর বয়সি দু' ছেলেমেয়ের বাবা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ।সারাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে । সকলের তখন একটাই চাওয়া দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী সারা বাংলাদেশে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে । যুবতি মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যুবকদের হত্যা করছে, গােরু-বাছুর কেড়ে নিচ্ছে, ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করছে, অগ্নিসংযােগে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং আরও নানা উপায়ে সাধারণ মানুষকে সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে হত্যা করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। এমন অরাজক পরিস্থিতিতে আমার ভগ্নিপতি আমাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন । তিনি আমাকে জানালেন যে, মেজর জলিল ভারতে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করছেন। আমি যদি মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল তৈরি করে ভারতে চলে যাই, তবে।
তিনি মেজর জলিলের কাছে একটি চিঠি লিখে দিবেন । এরপরই সংসার-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে উজিরপুরের বাষট্টি জন তরুণকে নিয়ে নয় নম্বর সেক্টর ভগ্নিপতির কথায় উৎসাহিত হয়ে আমিও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিতে থাকি। অধিনায়ক মেজর (অব.) জলিলের নেতৃত্বে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেই। আমার প্রথম অপারেশন ছিল সাতক্ষীরা জেলার দবেহাটা থানায় । সেখানকার কুলিয়া চেয়ারম্যান বাড়িতে ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্প। ২২ নভেম্বর সেক্টর কমান্ডার আমাদেরকে তার নেতৃত্বে ঐ ক্যাম্প আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। আমি ছিলাম প্লাটুন কমান্ডার। আনুমানিক রাত বারােটার দিকে আমি আমার প্লাটুন নিয়ে নির্দেশ অনুযায়ী অবস্থান নেই। অন্য পাটুনগুলােও নির্দেশ অনুযায়ী যার যার অবস্থান নেয়। কমান্ডারের সংকেত পাবার সাথে সাথেই শুরু হয় আক্রমণ । অন্যদিক থেকেও শত্রুসেনারা পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে। কয়েক ঘন্টা গােলাগুলির পর পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় । আমাদের অভিযান সফল হয়। আমরা ক্যাম্প দখল করে নিলাম । কিন্তু আমার প্লাটুনের পাঁচজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয় ও একজন নিহত হয়। আহত ও নিহত মুক্তিযােদ্ধাদেরকে আমরা কাধে করে নিয়ে পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে ইছামতি নদী পার হয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই। নদী পার হবার পরই আনন্দবাজার পত্রিকার একজন সাংবাদিক আমাদের একটি ছবি ধারণ করেছিল । বিষয়টি খেয়াল করারও সুযােগ ঐ সময় আমাদের ছিল না। স্বাধীনতার পর ছবিটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এটি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। অতঃপর ডুমুরিয়া থানাধীন বাদামতলা থানা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বেও ছিলাম আমি। মেজর জলিল আমাকে খবর দিলেন, আফছার উদ্দিন মােল্লা নামে এক রাজাকার কমান্ডার শাহাপুর নামক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত এবং তার নিকট কিছু অস্ত্র আছে। সেই অস্ত্র আমাদের উদ্ধার করতে হবে । ঐ রাজাকারের বাড়ি আমাদের ক্যাম্প থেকে দেড় কিলােমিটার দূরে ছিল । আমি ইসমাইল নামে একজন মুক্তিযােদ্ধাকে ভিক্ষুকের বেশে ঐ বাড়িতে পাঠালাম সব তথ্য সংগ্রহের জন্য। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম যে, রাজাকার কমান্ডারের প্রথম স্ত্রী অনেক দূরে এক বাড়িতে অস্ত্র নিয়ে থাকে। আর আফছার মােল্লা এক হিন্দু মেয়েকে জোর করে বিয়ে করে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গেছে। এরপর আমরা রাজাকারের প্রথম স্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে তার সাথে নানা কথা বলে বিশ্বাস স্থাপন করি। তারপর তাকে বলি যে, মুক্তিযােদ্ধারা জেনে গেছে তার কাছে অস্ত্র আছে। সে যদি অস্ত্র দিতে না চায় তবে তারা তার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিবে এবং তাকেও মেরে ফেলতে পারে । কিন্তু সে যদি অস্ত্র দিয়ে দেয় তবে তার কোনাে ক্ষতি হবে না। এভাবে মহিলার কাছ থেকে কৌশলে অস্ত্রের তথ্য জেনে নিয়ে দশটি অস্ত্র এবং কিছু পরিমাণ গােলাবারুদ উদ্ধার করে নিয়ে আসি আমরা। এ অপারেশন সফলভাবে পরিচালনা করার পর মেজর জলিল আমাকে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার দলবীর সিং-এর কাছে সাহসী ও বিশ্বস্ত বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর খুলনাকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি আমাকে প্রস্তুত হতে বললেন। আমিও নতুন মিশনে নামার জন্য দৃঢ় মনােবল নিয়ে প্রস্তুত হলাম। বিভিন্নভাবে নানা কৌশল প্রয়ােগ করে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলাম । এভাবে একের পর এক অপারেশন পরিচালনা করার পর খুলনাকে শত্রুমুক্ত করতে সফলকাম হলাম । এ অপারেশন সফলভাবে পরিচালনা করার পর শােলপুর ভারতীয় ব্রিগেডিয়ারের সাথে দেখা করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘মুক্তি ভাই, আপ তােমাকে দেশ। হাে গিয়া’ । তার সাথে ছিল আরও দু’জন সহযােদ্ধা।
দেশ স্বাধীন হবার খবর পাবার আনন্দে লােকটি তার হাতে থাকা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানাের চেষ্টা করার মাত্রই ব্রাশফায়ার করা হলাে তাকে। সেখানে যে পাকিস্তানি ক্যাম্প ছিল বিজয়ের আনন্দে একটি তাদের খেয়ালই ছিল না। এরকম নানা বেদনাদায়ক বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়েও আমরা মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। অতঃপর প্রাণপণ যুদ্ধ করে আমার প্রিয় দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে বিজয়ীবেশে ফিরে এলাম পরিবার পরিজনের কাছে। কত বিনিদ্র রজনী, কত সহযােদ্ধাদের চিরতরে হারানাের অবর্ণনীয় কষ্ট, শরীরে শত আঘাতের চিহ্ন নিয়ে আমি আকরাম হােসেন আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। মহান মুক্তিযুদ্ধও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মৃতি, সাহসী অভিযান এবং রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আধারে আমার জীবন আচ্ছাদিত হয়ে রয়েছে । প্রিয় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি চাই আমাদের বর্তমান প্রজন্মও দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠুক এবং অন্তর দিয়ে ভালােবাসতে শিখুক প্রিয় মাতৃভূমিকে। তবেই বীরশহিদদের আত্মত্যাগ সফল হবে।