বাংলা রচনা : পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন
পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন |
পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়ন
অথবা, বৃক্ষরােপণ অভিযান
অথবা, পরিবেশ উন্নয়নে বৃক্ষরােপণ
অথবা, বনায়ন কর্মসূচি।
[সংকেত : ভূমিকা; বৃক্ষের প্রকারভেদ;বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা;বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ; বৃক্ষের সামগ্রিক অবদান; দুর্যোগ মােকাবিলায় বৃক্ষের অবদান; বৃক্ষানন ও তার প্রতিকার; বৃক্ষরােপণ অভিযানে সরকারি উদ্যোগ; বৃক্ষরােপণ অভিযানের গুরুত্ব; বৃক্ষরােপণ অভিযানের উদ্দেশ্য; বৃক্ষমেলা; বন বিভাগের নার্সারি; উপসংহার ]ভূমিকা : বৃক্ষ বা গাছ মানুষের পরম বন্ধু। সভ্য যুগের আগে থেকেই মানুষ গাছকে বন্ধু হিসেবে
বন্ধ। সভ্য যুগের আগে থেকেই মানম গাছকে বন্ধ হিসেবে পেয়েছে। যখন মানুষ আগুন স্বালাতে শেখেনি তখন গাছের ফল-মূল খেয়েই জীবনযাপন করেছে। যখন মানুষ ঘর বানানাে শেখেনি তখন গাছের ছায়ায় মানুষ বিশাম নিয়েছে। শিকার ধরার জন্য মানষ গাছে আশ্রয় নিয়েছে। সভ্যতা গড়ে ওঠার আগে থেকেই মানুষ গাছ থেকে নিচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। মানুষ গাছের কাঠ দিয়েই ঘরবাড়ি তৈরি করতে শিখেছে। জ্বালানি হিসেবে গাছকে কাজে লাগিয়েছে। এরপর সভ্যতা যতই এগিয়েছে মানুষের উপকারী বন্ধ হিসেবে গাছ মানুষকে আরও অনেক ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছে। সব মাগুণ এর প্রতিদান দিয়েছে খুব নির্মমভাবে। মানুষ গাছকে বন্ধ ভাবতে পারেনি। নির্বিচারে গাছ কেটে বনাঞ্চলে বসাত স্থাপন করেছে। এতে মানুষ নিজেদেরই ক্ষতি করছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়ােজন পরিমাণমতাে বনাঞ্চল ।
বৃক্ষের প্রকারভেদ : বৃক্ষ বলতে সাধারণত বড়াে গাছকে বােঝানাে হয়। গাছ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বনভূমিকে পাচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যথা-
(ক) ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ,
(খ) ক্রান্তীয় আধা চিরসবুজ,
(গ) ক্রান্তীয় আদ্র পত্রমােচী,
(ঘ) জোয়ারধৌত বন এবং
(ঙ) কৃত্রিম বন।
এসব প্রকারের মধ্যে আছে ফলের গাছ, ঔষধি গাছ, ফুলের গাছ, ঝাউ গাছ। সুন্দরবন অঞ্চল আমাদের দেশের সুন্দরি কাঠের জন্য সুপরিচিত। এছাড়াও রয়েছে গজারি গাছ, কেওড়া ইত্যাদি গাছ।
বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা : মানুষের জীবন রক্ষার্থে সবচেয়ে বেশি অবদান বৃক্ষের। বৃক্ষ থেকে নির্গত অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেচে আছি। আর আমাদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে বৃক্ষ পরিবেশকে বিষমুক্ত করে । পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখে বৃক্ষ। প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাতে বৃক্ষের অবদান রয়েছে। বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এতে পরিবেশ ও আবহাওয়া থাকে নাতিশীতােষ্ণ ও হিমশীতল । মানুষের শরীর থাকে সুস্থ স্বাভাবিক। বৃক্ষ যেমন আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনে তেমনি প্রচুর বৃষ্টিপাতও ঘটায়। এতে মাটি উর্বর হয়, ফসল ফলে ভালাে। কিন্তু মানুষ নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছে। এতে মানুষের জীবনধারণ ও পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ঝড়-তুফান, নদীভাঙন বাড়ছে; ফুল-ফলের পরিমাণ কমছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মানুষের জীবন বাঁচাতে ও পরিবেশ রক্ষার্থে বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম।
বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ : সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের জন্মভূমি পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। আবার এই দেশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। এই বনে রয়েছে। সুন্দরি গাছসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ। কিন্তু দিন দিন বৃক্ষ নিধনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে বনভূমি প্রায় ধ্বংসের পথে। একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়ােজন ২৫% বনভূমি। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৬.৪৬% । মাথাপিছু বনের পরিমাণ ০.২২ হেক্টর। বনভূমি রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বৃক্ষের সামগ্রিক অবদান : মানবজীবনে সবচেয়ে বেশি উপকার করে বৃক্ষ। মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসের যােগান দেয় বৃক্ষ। তাছাড়া ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্রসহ মানবজীবনে প্রয়ােজনীয় অনেক কিছুই বৃক্ষ থেকে তৈরি করা হয়। জালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হয় এবং আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম।
দুর্যোগ মােকাবিলায় বৃক্ষের অবদান : প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ হানা দেয়। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলােচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি। এতে দেশের অনেক ক্ষতি হয়। অঞ্চল বিশেষে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষ সেখানকার পরিবেশ ও । ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, জমিকে ফসল ফলানাের উপযােগী করে তােলে। বক্ষ নদীভাঙন রক্ষা করে, ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমিয়ে দেয়। অনাবৃর ২৩ থেকে ফসাল জমিকে রক্ষা করে। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মােকাবিলায় বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ।
বৃক্ষানন ও তার প্রতিকার : বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু হলেও প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে বৃক্ষ কাটা হচ্ছে। কেউবা জ্বালানির জন্য, কেউবা অর্থের প্রয়ােজনে আবার কেউবা ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরি করতে বক্ষনিধন করছে। এতে বনজ সম্পদ কমছে। আমাদের এই বক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। একটি গাছ কাটার সাথে সাথে দশটি গাছ লাগাতে হবে। ধ্বংস নয় সষ্টি— এমন মনােভাব নিয়ে বক্ষ রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই পরিবেশ রক্ষার সময়ােপযােগী বনাঞ্চল গড়ে তােলা সম্ভব হবে।
বৃক্ষরােপণ অভিযানে সরকারি উদ্যোগ : ১৯৯৫ সালে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ২০ কোটি চারা বিক্রয় ও বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিটিসি চলতি মৌসুমে প্রায় ৩ লাখ চারা বিনামূল্যে বিতরণ করে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭ হাজার চারা রােপণ করে। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ভেড়ামারা, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বনায়ন শুরু হয়েছে। বেশকিছু উদ্যোগী লােক বিভিন্ন রাস্তা, সেচ প্রকল্পের খাল ও বিভিন্ন জায়গা লিজ নিয়ে বৃক্ষরােপণ শুরু করেছেন। এরা অন্যান্য সুফলসহ আর্থিক দিক দিয়েও লাভবান হচ্ছেন। দেশের ব্যস্ত মহানগরগুলােসহ বিভিন্ন। শহরের রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরােপণ করা যায়। লায়ন্স, রােটারি ও লিও ক্লাবগুলােসহ অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বৃক্ষরােপণ অভিযানে সহায়তা দিচ্ছে। সেই থেকে প্রতিবছর সরকারি ও বেরসকারি উদ্যোগে বৃক্ষরােপণ অভিযান চলে।
বৃক্ষরােপণ অভিযানের গুরুত্ব : বাংলাদেশের মতাে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশে বৃক্ষরােপণ অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার প্রভৃতির যােগান দিতে গিয়ে চাপ পড়ছে বনজ সম্পদ ও বনভূমির ওপর। প্রতি বছরই বনজ সম্পদ ও বনভূমি কমছে। এ পরিস্থিতিতে গ্রামে-গঞ্জে বা বনভূমিতে প্রকৃতির ইচ্ছা অনুযায়ী গাছপালা জন্মানাে ও বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। বনজ সম্পদ বাড়ানাের একমাত্র উপায় হলাে বৃক্ষরােপণ করা । সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যেখানে শতকরা ২৫ ভাগ বনজ সম্পদ ও বনভূমি থাকা দরকার, সেখানে আমাদের দেশে বন রয়েছে শতকরা। ১৬.৪৬ ভাগ। বনাচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ শতকরা ১০ ভাগ ।
বৃক্ষরােপণ অভিযানের উদ্দেশ্য : বৃক্ষরােপণ অভিযানের মাধ্যমে বৃক্ষের উপকারিতা ও সংরক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে গণসচেতনতা বাড়ানাে যায়। সরকারি বনভূমিই বনজ সম্পদ সৃষ্টির একমাত্র উৎস নয়, এক্ষেত্রে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির আশেপাশের আঙ্গিনায় ছােটো-বড়াে যেকোনাে গাছের চারা লাগানাের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে । মসজিদ, মন্দিরের খালি জায়গা, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গাছ লাগানাের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বাড়ানাে যায় । বৃক্ষরােপণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমােচন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। বন্য প্রাণীর আবাসস্থল তৈরি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করা যায়। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম বৃক্ষরােপণ অভিযানের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ বন বিভাগ এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সফল করার লক্ষ্যে বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরােপণ অভিযান পালন, এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, রেডিও, টিভিতে এ অভিযান সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানাে, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে তা প্রচার করা ও বৃক্ষরােপণ অভিযান উপলক্ষ্যে প্রতি বছর র্যালি আয়ােজন করা হয় । এছাড়া সারা দেশব্যাপী বৃক্ষমেলার আয়ােজন, বৃক্ষ সম্পর্কিত লিফলেট, পােস্টার ও বিনামূল্যে পুস্তিকা বিতরণ করা হচ্ছে।
বৃক্ষমেলা : বৃক্ষরােপণে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বৃক্ষের উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য সারা দেশব্যাপী জেলা ও থানা সদরে ১৯৯৪ সাল থেকে বৃক্ষমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারা দেশে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে । বৃক্ষমেলায় গাছের চারা, আসবাবপত্র, পরিবেশ সম্পর্কিত ও বন গবেষণাসহ বিনােদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বৃক্ষরােপণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ও সকলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সরকার ১৯৯২ সাল থেকে বৃক্ষরােপণ পুরস্কার প্রবর্তন করেন । এতে প্রতি বছর ৯টি করে ২৭টি পুরস্কার প্রদান করা হয় ।
বন বিভাগের নার্সারি : ১৯৯৪ সালে বন বিভাগের বিভিন্ন নার্সারি কেন্দ্র থেকে ১ কোটি ৮ লাখ চারা বিতরণ করা হয়। সরকারি নার্সারি কেন্দ্র হতে এসব চারা বিক্রি হয়। বৃক্ষরােপণ অভিযানের ফলে প্রতি বছর বৃক্ষরােপণে জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বাংলাদেশে সরকারি নার্সারির পাশাপাশি ৫ হাজার ৫শটি বেসরকারি নার্সারি গড়ে উঠেছে। বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সার্থক করার জন্য বেশ কয়েকটি এনজিওসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে।
উপসংহার : বক্ষ মানুষের পরম বন্ধু । একজন মানুষের কমপক্ষে তিনটি গাছ লাগানাে উচিত। একটি ফুলের, একটি ফলের ও একটি ঔষধি । তাহলেই বক্ষরােপণ অভিযান সফল হবে। গাছ বাড়লে মানুষের জীবন বাচবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃক্ষ সম্পর্কে। বলেছেন—
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা : মানুষের জীবন রক্ষার্থে সবচেয়ে বেশি অবদান বৃক্ষের। বৃক্ষ থেকে নির্গত অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেচে আছি। আর আমাদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে বৃক্ষ পরিবেশকে বিষমুক্ত করে । পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখে বৃক্ষ। প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটাতে বৃক্ষের অবদান রয়েছে। বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এতে পরিবেশ ও আবহাওয়া থাকে নাতিশীতােষ্ণ ও হিমশীতল । মানুষের শরীর থাকে সুস্থ স্বাভাবিক। বৃক্ষ যেমন আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনে তেমনি প্রচুর বৃষ্টিপাতও ঘটায়। এতে মাটি উর্বর হয়, ফসল ফলে ভালাে। কিন্তু মানুষ নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করছে। এতে মানুষের জীবনধারণ ও পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ঝড়-তুফান, নদীভাঙন বাড়ছে; ফুল-ফলের পরিমাণ কমছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মানুষের জীবন বাঁচাতে ও পরিবেশ রক্ষার্থে বৃক্ষরােপণের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীম।
বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ : সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের জন্মভূমি পৃথিবীর একমাত্র জীবন্ত বদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। আবার এই দেশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। এই বনে রয়েছে। সুন্দরি গাছসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ। কিন্তু দিন দিন বৃক্ষ নিধনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে বনভূমি প্রায় ধ্বংসের পথে। একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়ােজন ২৫% বনভূমি। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৬.৪৬% । মাথাপিছু বনের পরিমাণ ০.২২ হেক্টর। বনভূমি রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বৃক্ষের সামগ্রিক অবদান : মানবজীবনে সবচেয়ে বেশি উপকার করে বৃক্ষ। মানুষের জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসের যােগান দেয় বৃক্ষ। তাছাড়া ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্রসহ মানবজীবনে প্রয়ােজনীয় অনেক কিছুই বৃক্ষ থেকে তৈরি করা হয়। জালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হয় এবং আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অপরিসীম।
দুর্যোগ মােকাবিলায় বৃক্ষের অবদান : প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ হানা দেয়। যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলােচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি। এতে দেশের অনেক ক্ষতি হয়। অঞ্চল বিশেষে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষ সেখানকার পরিবেশ ও । ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, জমিকে ফসল ফলানাের উপযােগী করে তােলে। বক্ষ নদীভাঙন রক্ষা করে, ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমিয়ে দেয়। অনাবৃর ২৩ থেকে ফসাল জমিকে রক্ষা করে। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ মােকাবিলায় বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ।
বৃক্ষানন ও তার প্রতিকার : বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু হলেও প্রয়ােজনে-অপ্রয়ােজনে বৃক্ষ কাটা হচ্ছে। কেউবা জ্বালানির জন্য, কেউবা অর্থের প্রয়ােজনে আবার কেউবা ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরি করতে বক্ষনিধন করছে। এতে বনজ সম্পদ কমছে। আমাদের এই বক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। একটি গাছ কাটার সাথে সাথে দশটি গাছ লাগাতে হবে। ধ্বংস নয় সষ্টি— এমন মনােভাব নিয়ে বক্ষ রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই পরিবেশ রক্ষার সময়ােপযােগী বনাঞ্চল গড়ে তােলা সম্ভব হবে।
বৃক্ষরােপণ অভিযানে সরকারি উদ্যোগ : ১৯৯৫ সালে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ২০ কোটি চারা বিক্রয় ও বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিটিসি চলতি মৌসুমে প্রায় ৩ লাখ চারা বিনামূল্যে বিতরণ করে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭ হাজার চারা রােপণ করে। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ভেড়ামারা, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও বনায়ন শুরু হয়েছে। বেশকিছু উদ্যোগী লােক বিভিন্ন রাস্তা, সেচ প্রকল্পের খাল ও বিভিন্ন জায়গা লিজ নিয়ে বৃক্ষরােপণ শুরু করেছেন। এরা অন্যান্য সুফলসহ আর্থিক দিক দিয়েও লাভবান হচ্ছেন। দেশের ব্যস্ত মহানগরগুলােসহ বিভিন্ন। শহরের রাস্তাঘাট, ট্রেন লাইনসহ বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরােপণ করা যায়। লায়ন্স, রােটারি ও লিও ক্লাবগুলােসহ অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বৃক্ষরােপণ অভিযানে সহায়তা দিচ্ছে। সেই থেকে প্রতিবছর সরকারি ও বেরসকারি উদ্যোগে বৃক্ষরােপণ অভিযান চলে।
বৃক্ষরােপণ অভিযানের গুরুত্ব : বাংলাদেশের মতাে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশে বৃক্ষরােপণ অভিযানের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার প্রভৃতির যােগান দিতে গিয়ে চাপ পড়ছে বনজ সম্পদ ও বনভূমির ওপর। প্রতি বছরই বনজ সম্পদ ও বনভূমি কমছে। এ পরিস্থিতিতে গ্রামে-গঞ্জে বা বনভূমিতে প্রকৃতির ইচ্ছা অনুযায়ী গাছপালা জন্মানাে ও বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। বনজ সম্পদ বাড়ানাের একমাত্র উপায় হলাে বৃক্ষরােপণ করা । সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যেখানে শতকরা ২৫ ভাগ বনজ সম্পদ ও বনভূমি থাকা দরকার, সেখানে আমাদের দেশে বন রয়েছে শতকরা। ১৬.৪৬ ভাগ। বনাচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ শতকরা ১০ ভাগ ।
বৃক্ষরােপণ অভিযানের উদ্দেশ্য : বৃক্ষরােপণ অভিযানের মাধ্যমে বৃক্ষের উপকারিতা ও সংরক্ষণের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে গণসচেতনতা বাড়ানাে যায়। সরকারি বনভূমিই বনজ সম্পদ সৃষ্টির একমাত্র উৎস নয়, এক্ষেত্রে জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির আশেপাশের আঙ্গিনায় ছােটো-বড়াে যেকোনাে গাছের চারা লাগানাের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে । মসজিদ, মন্দিরের খালি জায়গা, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গাছ লাগানাের মাধ্যমে বনজ সম্পদ বাড়ানাে যায় । বৃক্ষরােপণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমােচন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। বন্য প্রাণীর আবাসস্থল তৈরি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করা যায়। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম বৃক্ষরােপণ অভিযানের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ বন বিভাগ এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সফল করার লক্ষ্যে বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরােপণ অভিযান পালন, এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ, রেডিও, টিভিতে এ অভিযান সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানাে, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে তা প্রচার করা ও বৃক্ষরােপণ অভিযান উপলক্ষ্যে প্রতি বছর র্যালি আয়ােজন করা হয় । এছাড়া সারা দেশব্যাপী বৃক্ষমেলার আয়ােজন, বৃক্ষ সম্পর্কিত লিফলেট, পােস্টার ও বিনামূল্যে পুস্তিকা বিতরণ করা হচ্ছে।
বৃক্ষমেলা : বৃক্ষরােপণে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বৃক্ষের উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য সারা দেশব্যাপী জেলা ও থানা সদরে ১৯৯৪ সাল থেকে বৃক্ষমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সারা দেশে অনুষ্ঠিত বৃক্ষমেলায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে । বৃক্ষমেলায় গাছের চারা, আসবাবপত্র, পরিবেশ সম্পর্কিত ও বন গবেষণাসহ বিনােদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বৃক্ষরােপণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ও সকলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য সরকার ১৯৯২ সাল থেকে বৃক্ষরােপণ পুরস্কার প্রবর্তন করেন । এতে প্রতি বছর ৯টি করে ২৭টি পুরস্কার প্রদান করা হয় ।
বন বিভাগের নার্সারি : ১৯৯৪ সালে বন বিভাগের বিভিন্ন নার্সারি কেন্দ্র থেকে ১ কোটি ৮ লাখ চারা বিতরণ করা হয়। সরকারি নার্সারি কেন্দ্র হতে এসব চারা বিক্রি হয়। বৃক্ষরােপণ অভিযানের ফলে প্রতি বছর বৃক্ষরােপণে জনগণের অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বাংলাদেশে সরকারি নার্সারির পাশাপাশি ৫ হাজার ৫শটি বেসরকারি নার্সারি গড়ে উঠেছে। বৃক্ষরােপণ অভিযানকে সার্থক করার জন্য বেশ কয়েকটি এনজিওসহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে।
উপসংহার : বক্ষ মানুষের পরম বন্ধু । একজন মানুষের কমপক্ষে তিনটি গাছ লাগানাে উচিত। একটি ফুলের, একটি ফলের ও একটি ঔষধি । তাহলেই বক্ষরােপণ অভিযান সফল হবে। গাছ বাড়লে মানুষের জীবন বাচবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃক্ষ সম্পর্কে। বলেছেন—