বাংলা রচনা : আমার প্রিয় ঋতু শরৎ
আমার প্রিয় ঋতু শরৎ |
আমার প্রিয় ঋতু শরৎ
[সংকেত: ভমিকা; প্রিয় হওয়ার কারণ; শরতের বৈশিষ্ট্য; শরতের অপূর্ব রূপরাশি; শরতের রাত; শরৎ সকালের সৌন্দর্য; মানব মনে শরতের প্রভাব; শারদীয় ছুটি ও সাহিত্য; উপসংহার। ]
ভূমিকা : বিচিত্র রূপের নৈসর্গিক লীলাভূমি আমাদের এ বাংলাদেশ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের দেশাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক বিপুল ভান্ডার। ঋতুবৈচিত্র্যের আবর্তনে বর্ষার বিষন্নবিধুর নিঃসঙ্গতার পর প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে নিঃশব্দ চরণ ফেলে ঋতুর রানি শরতের আবির্ভাব। শরৎ-প্রকৃতির প্রসন্ন হাসি আর সুবর্ণ মােহন কান্তি দর্শনে মানুষমাত্রই মুগ্ধ হয়।
প্রিয় হওয়ার কারণ : প্রকতির নিকেতনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক এক ঋত তার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে তােলে। তার মধ্যে গৈরিক গ্রীষ্ম রূদ-তাপস সজল বর্ষা বিরহ-কাতর, হেমবরণী হেমন্ত বিষণ-
বিশ জরা-জর্জর শীত অশীতিপর সন্ন্যাসা, মাতাল বসন্ত। মদমত্ত যৌবন বিলাসী; কিন্তু শুভ্র শরৎ উদার ঐশ্বর্যে পূর্ণ; তার অঞ্জলিভরা নির্মল নিসর্গ নিবেদন। তাই শরৎ আমার প্রাণের ঋতু, অতি প্রিয় ।
শরতের বৈশিষ্ট্য : বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শােভা ধারণ করে আবির্ভূত হয় । ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি, গােলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি ফুল ফোটে। বিলে-ঝিলে ফোটে পদ্ম, শাপলা আর। নদীর ধারে ফোটে কাশফুল। এ সময় গাছে গাছে তাল পাকে। এই পূত-পুণ্য শরতেই দেবী দুর্গা কৈলাশ ছেড়ে মর্ত্যলােকে বেড়াতে আসেন; অর্থাৎ শরৎকালেই অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।
শরতের অপূর্ব রূপরাশি : শরৎ শুভ্রতার প্রতীক। শরৎ পূর্ণতার ঋতু। তার স্নিগ্ধ রূপ-মাধুর্য সহজেই আমাদের মনকে নাড়া দেয়। মুখে তার মায়াময় প্রসন্ন হাসি । গাছের পাতায় ঝলমলে রােদের ঝিলিক, টলমলে ভরা দিঘির জল, নদীতীরে ফুটে থাকা অজস্র। কাশফুল, শিউলি ফুলের গন্ধে ভরা উদাস করা সকালের নরম বাতাস, আকাশ জুড়ে তুলাের মতাে শুভ্র মেঘ, ধানের খেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা- এসবই জানিয়ে দেয় ঋতুর রানি শরৎ এসে গেছে। সত্যিই শরৎ প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের তুলনা নেই । গাঢ় নীলাকাশে সাদা সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। সরসীতে শাপলা-পদ্মের নয়ন মুগ্ধকর শােভা । দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের খেত। গাছে গাছে সবুজ পাতার ছড়াছড়ি। শিউলিঝরা প্রাঙ্গণ, বাতাসে তার মিষ্টি সৌরভ । উঠানে গুচ্ছগুচ্ছ দোপাটির বর্ণসজ্জা। শারদ-লক্ষ্মীর এই অনুপম রূপলাবণ্য বাংলাদেশকে করেছে এক সৌন্দর্যের অমরাবতী। কবি শরতের অপূর্ব স্নিগ্ধ শােভা দেখে গেয়েছেন—
মাতার কণ্ঠে শেফালি মাল্য গন্ধে ভরেছে অবনী
জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত শুভ্র যেন সে নবনী।
পরেছে কিরীট কনক কিরণে
মধুর মহিমা হরিতে হিরণে
কুসুম-ভূষণ জড়িত চরণে দাঁড়িয়েছে মাের জননী।
জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত শুভ্র যেন সে নবনী।
পরেছে কিরীট কনক কিরণে
মধুর মহিমা হরিতে হিরণে
কুসুম-ভূষণ জড়িত চরণে দাঁড়িয়েছে মাের জননী।
শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ওই—
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই।
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই।
আজিকে তােমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শােভাতে।
হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ! শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শােভাতে।
মানব মনে শরতের প্রভাব : শরৎ প্রকৃত অর্থেই একটি মনােমঞ্চকর ঋত। নাতিশীতােষ্ণ শরতের আবহাওয়ায় মানুষের দেহ-মনে বিরাজ করে সংসার বিরাগী এক সত্তা। যার প্রভাবে মন শুধু বাইরে ছুটে বেড়াতে চায়। বিশেষত শারদকালীন পূর্ণিমা সংবেদনশীল প্রকৃতিপ্রেমা মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। শরতের পূর্ণ শশীর আলােয় নদীতীরে শুভ্র কাশবন, আঙিনায় নারকেল গাছের পাতা (থা দেখে মনে হয়, যেন কোনাে মায়াবিনী কেশবতী কন্যা তার মাথার চুল খুলে বসে আছে শারদ পূর্ণিমা রাতে, অথবা। সে জ্যোমা-মাণ করছে!) এবং ঝাউগাছগুলাে বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নত্য করে, যা দেখে মানুষের মন বিমােহিত হয়ে যায়। দিনের মুগ্ধ সােনালি রােদ আর রাতের স্নিগ্ধ রুপালি জ্যোৎস্নায় গহচড়া ও নদীবক্ষ হাস্যময়ী রূপ ধারণ করে। সারাক্ষণ মৃদু-মন্দ হাওয়া বইতে থাকে। ফোটা ফুলের গন্ধে পথচারীর মন-প্রাণ উদাস করে । শরৎ অপরূপ সৌন্দর্যের রহস্যের ইন্দ্রজাল বিছিয়ে বাংলার প্রকৃতিতে রানির মতাে বিরাজ করে।
শারদায় ছাড় ও সাহিত্য : শরতের হঠাৎ আলাের ঝলকানিতে বাঙালির মনে বেজে ওঠে ছুটির বাঁশি। আকাশে-বাতাসে তার উদার মুক্তির আহ্বান। শিভাল-বিতানে, শিশির-সিক্ত তণ-পল্লবে, আকাশের সীমাহীন নীলিমায় দোয়েল-শ্যামার কলকণ্ঠে, ভ্রমরের গুঞ্জনে। তার কেবলই উদাস হাতছানি ছুটির সাদর আমন্ত্রণে। অমনি গৃহবন্দি জীবনের ক্লান্তি ভুলতে মানুষ দূর-দূরান্তে বেরিয়ে পড়ে। শরৎ তাই ছুটির ঋতু। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, শরতের রৌদ্রের দিকে তাকাইয়া মনটা কেবল চলি চলি করে বর্ষার মতাে সে অভিসারে। চলা নয়, সে আভমানে চলা। এই ছুটির আনন্দের সঙ্গে বাঙালির জাতীয় উৎসবকে স্মরণীয় ও সার্থক করে তােলার জন্য বাঙালি কবি-সাহিত্যকের দল তাদের বরণীয় রচনা-সম্ভারে পরিপূর্ণ করে তােলেন সংবাদ সাময়িকীর শারদ সংখ্যাগুলাে। বিষয় বৈচিত্র্যে। সমুজ্জ্বল শারদসংখ্যাগুলাের এ সময়েই আবির্ভাব। কবি-সাহিত্যিকদের নব নব ভাবনা-চিন্তার ফসলে পাঠক-মন পরিতৃপ্ত হয়। এগুলাে শারদ-উৎসবের এক অনন্য সম্পদ।
উপসংহার : রূপসি বাংলার ষড়ঋতু নানা রূপের বিচিত্র সমারােহে নিত্য-আবর্তিত হয়ে চলে । বাংলা ঋতুচক্রের ধারায় বসন্ত যদি হয় ঋতুরাজ, তবে আপন শ্রী-ঐশ্বর্যে শরৎ ঋতুর রানি । শরতের আকাশ, সবুজ-শ্যামল নিসর্গ ও নদীর শান্তশ্রী সত্যিই নয়ন-মনােহর।। | শরতের প্রভাব বাঙালি জীবনে প্রকৃতির এক অনুপম আশীর্বাদ; রুদ্ধশ্বাস জীবনে মুক্তির খােলা বাতায়ন। সেজন্যই শতকণ্ঠে শরতের। শুভ্রতা ও বন্দনা ধ্বনিত হয়েছে। তাই কবি বলেন—
শরৎ রাণীর বাণী বাজে কমল দলে,
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলি তলে।
ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলি তলে।