বাংলা রচনা : জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের প্রভাব |
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের প্রভাব
অথবা, জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
অথবা, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশ
অথবা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বাংলাদেশ
অথবা, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন
ভূমিকা : সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ যে উন্নয়নের সৌধ-মিনার নির্মাণ করেছে, তার মূলে রয়েছে নিদারুণভাবে প্রকৃতির ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। তাই গােটা বিশ্ব আজ এক ভয়াবহ আতঙ্কে; জলবায়ুর সীমাহীন নেতিবাচক প্রভাব সমস্ত বিশ্ব-বিবেককে করেছে মূঢ়-ভাষাহীন। আর বিশ্বের এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থা আরও করুণ । অথচ অদ্যাবধি জলবায়ুর এ ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার মতাে টেকসই কোনাে পন্থা আবিস্কৃত হয়নি। সুতরাং জলবায়র এহেন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ববাসীর সঙ্গে বাংলাদেশকেও গভীর প্রত্যয়ে বাঁচার পথ আবিষ্কার করতেই হবে।
জলবায়ু ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রসঙ্গ : সাধারণত কোনাে স্থানের প্রতিদিনের বায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুচাপের মিলিত অবস্থাকে আবহাওয়া বলা হয়। আর আবহাওয়াবিদদের গবেষণা মতে, ঐ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের আবহাওয়ার গড় ফলই হলাে। জলবায়ু। আর এ জলবায়ুর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের নানা পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে উষ্ণায়নের মাত্রা বেড়ে যায়। আজ পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এক গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অবশ্য ইতােমধ্যে বিজ্ঞানীরা। জলবায়ুর নানাবিধ পরিবর্তন এবং এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের কারণসমূহ উদঘাটন করেছেন । উন্নত বিশ্বে বহুল আলােচিত গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রতিক্রিয়া বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ। গ্রিন হাউজ গ্যাসের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ভূমণ্ডলে ব্যাপক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণত মহাকাশ থেকে সূর্যের তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসে এবং তার অধিকাংশই আবার বিকিরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে চলে যায়। অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অত্যধিক কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস জমা হওয়ার ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করে ফলে এসব গ্যাসই তাপ শােষণ করে সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত রাখে । আইপিসিসি চতুর্থ প্রতিবেদন (২০০৭)-এর তথ্য থেকে জানা যায় যে, গত শতাব্দীতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ২৫%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ১৯% এবং মিথেনের পরিমাণ ১০০% বেড়েছে। এ পরিসংখ্যান থেকে অনুমিত হয় জলবায়ুর ভয়াবহতা কত মারাত্মক। এছাড়াও উন্নত বিশ্বে কলকারখানাসহ আয়েসি জীবনযাপনে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। ফলে সরাসরি বায়ুমণ্ডলকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে এবং ক্রমশ পৃথিবী ব্যাপকভাবে উষ্ণ হয়ে পড়েছে। এজন্য জলবায়ুর এক সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে সমস্ত পৃথিবী আজ দিশেহারা ।
জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব : বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তনে বিপন্ন মানুষের জীবন । শুধু মানুষ নয় পশু-পাখিসহ সমস্ত জীবকুল এর অপরিময় ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত। ইতােমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে ফলে মাত্রাতিরিক্ত খরা, অতিবৃষ্টি, প্লবন, মরুভূমির আয়তন বৃদ্ধি, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পানিতে লবণাক্ততা, সাইক্লোন, সুনামি, জলােচ্ছ্বাস, ভূমিধস, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, রােগ সংক্রমণসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আজ নিত্যসঙ্গী। বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত তথ্য মতে, এশিয়া মহাদেশের ১৩০ কোটি মানুষ হিমালয়ের হিমবাহ থেকে নির্গত পানির ওপর নির্ভরশীল কিন্তু এসব হিমবাহ অতিদ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাবে একদিকে যেমন প্রবল বন্যা কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে অন্যদিকে প্রচণ্ড খরা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও এরূপ প্রভাবে দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুইতৃতীয়াংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপপুঞ্জ আছে, যেগুলাে মাত্র ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লেই পুরােপুরি ডুবে যাবে । অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ এজন্য যে, এ কৃষিপ্রধান দেশে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব এক্ষেত্রেই মহাসংকটে ফেলবে ।
কৃষি ও জলবায়ু : বাংলাদেশে শীত মৌসুমে প্রায় ৩৬০০ বর্গকিলােমিটার এলাকা খরায় কবলিত হয়; অনেকে অনুমান করে ভবিষ্যতে আরও ২২০০ বর্গকিলােমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলে অনাবৃষ্টির ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ অঞ্চলের অধিকাংশ নদীই প্রায় শুকিয়ে যায়। আবার বর্ষা মৌসুমে প্রবল বন্যার ফলে কৃষিক্ষেত্রে বড়াে ধরনের অসবিধা। ইতােমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। গম, ভুট্টা, আলু ও সবজি চাষে এ ধরনের জলবায়ু সরাসরি ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অনাবৃষ্টির ফলে নদীর নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে— এজন্যও ফসল উৎপাদনে প্রয়ােজনীয় সময় সব মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে আকস্মিক বন্যার ভয়াবহতা তাে নতুন কিছু নয় ।
বন্যা ও গণমানুষ : অতিবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানিই বন্যার অন্যতম কারণ হলেও এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। আইপিসিসি-এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে জলবায়ন কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয় যে, অতিবৃষ্টি, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলে এই বন্যার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের বন্যায় কৃষি, মৎস্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব কারণে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুঃখদুর্দশায় পতিত হয়। এছাড়াও ঝড়-জলােচ্ছাসের মতাে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয় অসংখ্য মানুষ ।
ঝড়-জলােচ্ছ্বাস : সম্প্রতি ঝড়-জলােচ্ছাস বেড়ে গেছে। পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ সুনামি, সিডর, আইলা, নার্গিস, হারিকেন, টাইফুন, টর্নেডাে প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিশ্ব আজ নানাভাবে নিপতিত। এছাড়াও জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ক্ষতিকারক প্রভাবে লােনা পানির আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে ।
লােনা পানির আধিক্য : এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এদেশের জনসংখ্যার প্রায় পনেরো শতাংশ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। আইপিসিসি-এর সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়জনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পাবে এবং এতে ২৫,০০০ বর্গকিলােমিটার এলাকায় লােনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে । এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে পরিবেশের ওপর পড়বে সীমাহীন নেতিবাচক প্রভাব।
জলবায়ুর পরিবর্তন ও পরিবেশ : জলবায়ুর পরিবর্তন পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে । পরিবেশ বিপর্যয় থেকে এদেশে অপ্রতুল প্রাকৃতিক সম্পদেরও সংকট ঘটবে। এছাড়াও ইতােমধ্যে জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণে দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওড় অঞ্চল ব্যাপকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। অনেক প্রজাতি আজ এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে । ঋতুচক্রেও নানা ধরনের পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। একটি গবেষণায় অনুমান করা হচ্ছে যে, এভাবে পরিবেশ বিপর্যয় অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে উষ্ণতা আরও বেড়ে যাবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যেই পৃথিবীর বৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হবে। এছাড়াও জলবায়ুর এ ধরনের পরিবর্তনে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে ।
জনস্বাস্থ্যে জলবায়ুর প্রভাব : জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যেমন আর্থনীতিক ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্য। বিরাট সমস্যা হয়ে দাড়াবে। ফলে আমাদের মতাে দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি মােকাবিলা করা সত্যি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ইতােমধ্যেই এ ধরনের দুর্যোগের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। যেমন- মা ও শিশুরা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। সীমাহীন দাবদাহে কিংবা প্রচণ্ড শীতে শিশুদের জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া ও নিউমােনিয়ার মতাে মারাত্মক রােগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে । প্রতি শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে অধিক শিশু মারা যায়। বয়স্কদের মধ্যে হৃদরােগ, বহুমূত্র, কিডনির সমস্যা, যক্ষ্মা, চর্মরােগ ও মানসিক বৈকল্য দেখা দেয় । এছাড়াও ডেঙ্গু, সােয়াইনফ্লুসহ নানা ধরনের রােগের প্রকোপ থেকে কোনাে মানুষই আজ নিরাপদ নয়। আবার জলবায়ুর এ ধরনের প্রভাবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা যাচ্ছে ।
জীববৈচিত্র্য ও বাংলাদেশ : একথা ঠিক ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই চিরসবুজ বাংলাদেশ জলবায়র করুণ পরিণতির কাছে। আজ বড়াে অসহায়। ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক নদী ভাঙন, খরা আর অতিবর্ষণে যেমন ভূ-ভাগের ব্যাপক। পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তেমনি অনেক জীব তার স্বাভাবিক আবাসস্থল হারিয়ে অস্তিত্বের চরম সংকটে পড়েছে । তবে অনেক ক্ষেত্রে। কিছু জীব প্রায় বিপন্ন হয়েছে। প্রকৃতিতে এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাবে মানব-হিতৈষী কিছু বৃক্ষ আজ আর চোখে পড়ে না। অথচ এগুলাে আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রে অত্যন্ত মূল্যবান। অতিবর্ষণ আর বন্যায় সাজানাে-গােছানাে জনপদ বিলীন হচ্ছে; ফলে জনজীবনে ব্যাপক হতাশার জন্ম নিচ্ছে। সীমাহীন কৃষিজমি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হচ্ছে কিংবা ধু ধু বিরান বালুকাময় অনুর্বর ভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে যেকোনাে মুহূর্তেই এদেশে খাদ্যসংকট ঘটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সর্বোপরি এক চরম সংকটে আছে মানুষের জীবন ও জীববৈচিত্র্য। জলবায়ুর এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র অনেকে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমাণ : নানা তথ্য-উপাত্ত ও সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জলবায়ুর প্রত্যক্ষ পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রায় ৪১,৩০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়। এছাড়াও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মৌসুমি বায়ুর গতিপথ পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের ৩ কোটি লােক গৃহহারা হতে। পারে। ফলে পৃথিবীব্যাপী গৃহহারা মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক নবম্যান আইরিস-এর গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ২০ কোটি মানুষ গৃহহারা হবে। এছাড়াও আইপিসিসি-এর চতুর্থ সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে প্রায় ৮৩,০০০ হেক্টর। জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে; এছাড়াও ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধানের উৎপাদন শতকরা আট ভাগ হ্রাস পাবে এবং গমের উৎপাদন ৩২ শতাংশ কমে যাবে। সুতরাং উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত ও জলবায়ুর প্রভাবের প্রত্যক্ষ ফল বাংলাদেশের জন্য আজ এক বড়াে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ুর এরূপ হিংস্রতা থেকে মুক্তির পথ বের করতে হবে । পৃথিবীর পরিবেশবাদী শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে তাই বাংলাদেশও চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছে। সম্পৃক্ত হয়েছে বহুবিধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংগঠনে নেওয়া হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ।
বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন : ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল মার্কিন সিনেটর নেলসন ধরিত্রী দিবসের প্রচলন করেন। সেই থেকে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ পরিবেশের বিপর্যয় রক্ষার্থে এ দিবস পালন করে আসছে। বাংলাদেশও দিবসটি গুরুত্ব সহকারে উদ্যাপন করে। বাংলাদেশ এই সম্মেলনে চূড়ান্ত রূপরেখা পেশ করে। ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ধরিত্রী সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জলবায়ুর হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর ২০ বছর পর ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেরিও নগরীতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জলবায়ুর বিপর্যয়। রক্ষার্থে টেকসই উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করেন। এ সম্মেলনে সাইড ইভেন্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান উল্লেখ করেন যে, সবুজ অর্থনীতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশ ইতােমধ্যেই সােলার প্যানেল ও ব্রিক ফিল্ডে কার্বন নির্গমন কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনে অর্থায়ন করেছে। তবে এ সম্মেলনে বিশ্ব-সম্প্রদায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সহায়ক হিসেবে খাদ্য, পানি ও জ্বালানি সংকট মােকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে মডেল হিসেবে প্রতিভাত। হয়েছে বলেই সংশ্লিষ্টরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করছে।
প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলন : ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় ধরিত্রী রক্ষায় এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা উপস্থিত হন। প্রায় ৩১ পৃষ্ঠার এক চুক্তিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আইনি বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি পাঁচ বছর পরপর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়। এতে বলা আছে, উন্নয়নশীল ও দ্বীপরাষ্ট্র প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে উন্নত রাষ্ট্রগুলাে। যা কার্যকর হবে ২০২০ সালের পর থেকেই। সবচেয়ে বড়াে কথা হলাে এ সম্মেলনে প্রস্তাব করা হয় যে, ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা অনুমােদিত হয়। তবে উন্নত দেশগুলাে তাদের যে পরিকল্পনা জমা দিয়েছে তা ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অর্জিত হবে। এছাড়া চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করলে যেসব দেশের উৎপাদন কমে। যাবে তারা এর যথেষ্ট বিরােধিতা করে । আমেরিকার মতাে দেশের খােদ সিনেটেই বিষয়টি দ্বিধাবিভক্ত । তথাপি প্যারিসের কোপ-২১এ জলবায়ু পরিবর্তন রােধে বিশ্ববাসীর ঐকমত্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সুতরাং বাংলাদেশও এক্ষেত্রে আশার আলােই দেখতে পাচ্ছে।
উপসংহার : জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশ ছােটো দেশ হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তদুপরি আমাদের আর হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই; বরং একবিংশ শতাব্দীর এই চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় আমাদের জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলা দরকার । জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করতে যা যা করণীয় তাই করা উচিত। এজন্য ব্যাপক জনসচেতনতা অতীব প্রয়ােজন । আসুন জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযােগ্য করে গড়ে তুলি ।