বাংলা রচনা : একটি ঝড়ের রাত্রি

একটি ঝড়ের রাত্রি
একটি ঝড়ের রাত্রি

একটি ঝড়ের রাত্রি

[ সংকেত: ভূমিকা; ঝড়ের পূর্বমূহুর্ত; ঝড়ের পূর্বাভাস; ঝড়ের তাণ্ডবলীলা; ঝড়ের পরের মুহুর্ত; পরদিন সকালের চিত্র; ঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম; উপসংহার । ]

ভূমিকা : আমার জীবনে অনেক ঝড়ের রাত্রি এসেছে। কালবৈশাখির তাণ্ডব নৃত্যও দেখেছি; আবার আশ্বিনের অকাল প্রচণ্ড ঝড়ও দেখেছি। বইপত্রে অনেক ঝড়ের বর্ণনা পড়েছি। আবার মুরব্বিদের কাছে অনেক ঝড়ের বীভৎস কাহিনি শুনেছি। কিন্তু ১৪২৪ বঙ্গাব্দের ৩ জ্যৈষ্ঠে ঝড়ের যে তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করেছি, তার কাছে আমার দেখা এবং শােনা সমস্ত ঝড়ের রাত্রির স্মৃতিই ম্লান হয়ে গেছে।

ঝড়ের পূর্বমুহূর্ত : সে দিনটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর। মেঘমুক্ত নীল আকাশ। প্রখর রােদের সাথে ঝিরঝির বাতাসে বেশ চমৎকার মনে হচ্ছিল দিনটি। অথচ সন্ধ্যার প্রাক্কালে সমস্ত মানুষকে অবাক করে উত্তর-পশ্চিম কোণে দেখা দিল এক বিশাল ঘন-কালাে মেঘের । পাহাড়। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবছে, সন্ধ্যা নামছে আর মেঘের পাহাড় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সমস্ত আকাশ, গাছপালা, লতাপাতা, বাতাস নিস্তব্ধ। গাছের একটি পাতাও সামান্য নড়ে না, এমনকি সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখিরাও যেন কি এক অজানা আশঙ্কায় নীরবনিস্তব্ধ। সমস্ত আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছেয়ে গেল।

ঝড়ের পূর্বাভাস : সন্ধ্যা হতে না হতেই রেডিওতে হঠাৎ শােনা গেল আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের বুলেটিন। বঙ্গোপসাগরে গভীর নিমচাপ শুরু হয়েছে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে। উপকূলবর্তী মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে । নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট ঝড়টি শুধু উপকূলবর্তী এলাকায়ই নয় বরং দেশের বিভিন্ন স্থানেও আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

ঝড়ের তাণ্ডবলীলা : তখন রাত ৮টা বাজে হঠাৎ শুনতে পেলাম বাতাসের সই সই শব্দ । সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মতাে শব্দ করে। বাতাস আসছে, ঝড় আসছে, ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল চতুর্দিক। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর বাতাসের সাথে শুরু হলাে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাতাসের বেগ ক্রমে বাড়তে লাগল। চারদিকে কেবল শাে শো শব্দ, একের পর এক বজ্রপাতের বিকট আওয়াজ, আর ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকানিতে মনে হলাে যেন মহাপ্রলয় আসন্ন । মানুষের গগনভেদী চিৎকার আর আজানের ধ্বনি শুনে আমার শরীরে কাপন ধরেছে। আমাদের ঘরের পাশের বডাে আম গাছটি একটা বিকট মটমট শব্দ করে ভেঙে গেল। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার মার কান্নাকাটি ও বারবার নির্দেশে আমিও কয়েকবার আজান দিলাম। যদিও 'আজান দিলে ঝড় থামে' একথা আমি বিশ্বাস করি না। একবার জানালা একটু ফাক করে দেখলাম আমাদের বৈঠক ঘর এবং রান্নাঘরের চালা উড়ে গেছে, বেড়াগুলাে খুঁটিসহ হুমড়ি খেয়ে উঠানে পড়ে আছে। এমন সময় কোথা থেকে এক টিনের চালা এসে আমাদের ঘরের চালের সাথে প্রবল বেগে ধাক্কা খেল এবং আমরা এর প্রকাণ্ড শব্দে ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু আমাদের ঘরটি খুব শক্ত অর্থাৎ মজবুত হওয়াতে ভেঙে পড়েনি, তবু ভয়ের অন্ত ছিল না। সারাক্ষণ আমরা ভয়ে আতঙ্কিত ছিলাম । আমার সমস্ত চেতনা, শিরা-উপশিরা যেন। হিম হয়ে এলাে। এই অন্ধকার ভয়াল রাত্রি, সমস্ত পৃথিবী যেন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে । ঝড়ের শুরুতেই বিদ্যুৎ চলে গেছে। আমাদের। ঘরে একটি হারিকেন জ্বলছে। তাও আবার পাতিলের ভিতর বন্দি । কেননা বাতাসে এটিও নিভে যেতে পারে। এদিকে ঝড়ের বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে । প্রকৃতি যেন আজ পাগলপারা হয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে । রুদ্ররূপে প্রকৃতির এই ভীষণতম মূর্তি, এই ভয়াল রূপ স্বচক্ষে না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানাে যাবে না- ঝড় যেন ধ্বংসের প্রতীক, এক ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা।

ঝড়ের পরের মুহুর্ত : প্রায় মধ্যরাতের দিকে ঝড় থামল । কিন্তু বাতাস একেবারে থামেনি, মাঝেমধ্যে দমকা বাতাস বইছে। চতুর্দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল মানুষের কান্নার শব্দ, কিন্তু এই অন্ধকারে বেরােতে সাহস হলাে না। বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম আসছে না। মানুষের কান্না এবং আহাজারির অস্পষ্ট শব্দগুলাে শুনে মনে হলাে গ্রামের বাড়িঘর বুঝি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই । সবই বুঝি শেষ করে দিয়ে গেছে এই সর্বনাশা ঝড়। তাই ঘুম আর হলাে না। সমস্ত রাত্রিটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কাটল ।

পরদিন সকালের চিত্র : ভাের হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম। মেঘমুক্ত সীমাহীন নীল আকাশ, প্রকৃতির সব নীরব-নিস্তব্ধ । চারদিকে ধ্বংসস্তুপ। ভয়ে-বেদনায় বুক থর থর করে কাপতে লাগল। ধীরে ধীরে এগােতে লাগলাম পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ির দিকে। বৈদ্যুতিক তারের খুঁটি, গাছপালা, বাড়ি-ঘর সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সব স্তুপাকারে পড়ে আছে উঠানে, রাস্তাঘাটে, খেতে-খামারে। ফসলের মাঠের দিকে তাকানাে যায় না। সমস্ত ফসল সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে । বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপের নিচে পড়ে আছে অসংখ্য মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। এসব দেখে চোখ যেন ঝলসে যেতে চায় । অসংখ্য অসহায় নারী-পুরুষের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি যেন গুমরে গুমরে কাদছে। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য যে না দেখেছে তাকে বােঝানাে বড়াে কঠিন। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল । ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কাদি কিন্তু পারিনি। যতই বেলা বাড়তে লাগল ততই চতুর্দিক থেকে ধ্বংসের খবর, মৃত্যুর খবর আসতে লাগল । ঝড় যেন কেবল গরিব মানুষেরই গজব, মৃত্যুর অমানিশা, স্বজনহারা মানুষের গগনবিদারী আর্তচিৎকার ।

ঝড় পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম : ঝড় যেন গােটা অঞ্চলকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এমন কোনাে পরিবার নেই, যাদের ভিতরে স্বজন হারানাের ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। হাজার হাজার একর জমির ফসল নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বিধ্বস্ত মানুষগুলাে তবুও আবার নিজ নিজ বাড়ির পুননির্মাণ করার চেষ্টা করল। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয় । বিপর্যস্তদের পাশে দাঁড়াতে স্বেচ্ছাসেবীরা এগিয়ে আসে। নিঃস্ব পরিবারগুলাের ভরণপােষণের জন্য বিভিন্ন সাহায্য-সহযােগিতা করা হয়।

উপসহার : এই ভয়াবহ ধ্বংসলীলা আর বীভৎস মৃত্যুর দৃশ্য এ জীবনে কখনাে ভুলব না এবং ভুলারও নয়। এই স্মৃতি আমার হৃদয়ে, মনে, অস্থিমজ্জায় চিরদিন জেগে থাকবে ভয়ের কালােরাত্রি হিসেবে।
Next Post Previous Post
3 Comments
  • Unknown
    Unknown এপ্রিল ২৯, ২০২১

    জগদীশ চন্দ্র বসু রচনা চাই।

  • Unknown
    Unknown এপ্রিল ১২, ২০২২

    রচনা গুলো আরও বড় হলে ভালোই হতো।

  • Saleha Akhter
    Saleha Akhter এপ্রিল ০৭, ২০২৩

    Good!!

Add Comment
comment url