বাংলা রচনা : যখন সন্ধ্যা নামে
নদীর তীরে সূর্যাস্ত |
যখন সন্ধ্যা নামে
অথবা, নদীর তীরে সূর্যাস্ত
[সংকেত : ভূমিকা; সন্ধ্যার আগমনে প্রকৃতি; মানবজীবনে সন্ধ্যার প্রভাব; সন্ধ্যার অনবদ্য রূপ; সন্ধ্যার নিজনতা]
ভূমিকা : গােধূলি বেলা যখন গােরুর পাল ধুলা উড়িয়ে ঘরে ফেরে সেই সৰ্যাস্তকাল দিন-রাতের সন্ধিক্ষণকে বলে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা। বড়াে রহস্যময়। সন্ধ্যা দিনের আলাের অবসানের ইঙ্গিত, রাতের সুচনার আভাস। দিন-রাতের মিলনের এই সময়ে একই সঙ্গে প্রতিফলিত হয় দিনের বিদায়ের লগ্ন আর রাতের আবির্ভাবের সুচনা। সন্ধ্যা দিন আর রাতের হাত ধরা এক অন্য রূপ। দিন-রাতের ক্রান্তিকালে কিছু জানা কিছু অজানা, কিছু দেখা কিছু অদেখার পরিবেশ বড়াে মনােরম লাগে। পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় সন্ধ্যার প্রতিকৃতি-
দিবসের সহ-মরণ-চিতায় আপনারে দিতে তুলে,
সন্ধ্যা সাজিছে নানা আভরণে নাহিয়া নদীর কূলে।
সন্ধ্যা সাজিছে নানা আভরণে নাহিয়া নদীর কূলে।
সন্ধ্যার আগমনে প্রকৃতি : রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।
দিনের আলােক রেখা মিলিয়ে দূরে
নেমে আসে সন্ধ্যা ধরণীর পুরে।
তিমির ফেলেছে ছায়া।
ঘিরে আসে কাল মায়া
প্রান্তর কানন গিরি পল্লি বাট-মাঠ
অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ বিরাট।
নেমে আসে সন্ধ্যা ধরণীর পুরে।
তিমির ফেলেছে ছায়া।
ঘিরে আসে কাল মায়া
প্রান্তর কানন গিরি পল্লি বাট-মাঠ
অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ বিরাট।
মানবজীবনে সন্ধ্যার প্রভাব : কুলায় ফেরা পাখির মতাে সন্ধ্যা মানুষকে ফিরিয়ে আনে ঘরে । সন্ধ্যা কর্মমুখর দিনের যবনিকা টেনে দিয়ে শ্রমশ্রান্ত জীবনে শান্তির পরশ বুলায় । চতুর্দিক শান্ত, ধীর-স্থির; কেমন যেন একটা মৌন-বৈরাগ্য ভাব নিয়ে সন্ধ্যা পৃথিবীর দিগ্বলয় দ্বারে এসে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে বিচিত্র-বর্ণা প্রকৃতির রং বদলাতে থাকে। বিষাদিত গভীর মমতার গাঢ় ছায়া প্রকৃতির গায়ে ফেলে সন্ধ্যাসবিতা পশ্চিম গগনে ডুবে যায়। ক্রমে শ্লান হয়ে আসে আলাের রেখা। হালকা আঁধার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূরের দৃশ্যাবলি ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে একসময় আঁধারের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে রাতজাগা বাদুড়ের দলে দলে উড়ে যাওয়া চোখে পড়ে। তারা খাদ্যের সন্ধানে ফলবাগানে গিয়ে জমায়েত হয় । সন্ধ্যাকাশে উড়ে যাওয়া বাদুড়ের ঝাক দেখে ছােটোবেলা আমরা ছড়া কাটতাম—
বাদুড় বাদুড় মিতা
আমায় রেখে যে ফল খাবি
মুখে লাগবে তিতা ।
আমায় রেখে যে ফল খাবি
মুখে লাগবে তিতা ।
এছাড়া আবছা আলােয় বাঁশবনের দিকে উড়ে চলা বকের মিছিল দেখতে বড়াে মনােরম লাগে। শালিকের কলকাকলিতে সন্ধ্যাপরিবেশ ক্ষণিকের জন্য মুখর হয়ে ওঠে। রাখাল গােরুর পাল নিয়ে মাঠ থেকে ফিরে আসে। কৃষাণী ধূপ-ধুনা জ্বালিয়ে গােয়ালের মশা তাড়ায় । তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে, চারদিক থেকে হিন্দু-রমণীদের মুহুর্মুহু উলুধ্বনি শােনা যায়। মন্দিরে মন্দিরে ঘণ্টা নেড়ে, শাঁখ বাজিয়ে পূজারি শােনায় সন্ধ্যার আগমনী গৃহে গৃহে গীত হয় সন্ধ্যারতি। জুতাে-খড়ম হাতে নিয়ে ছেলে-বুড়াে সবাই পুকুর বা নদীর ঘাটে জমায়েত হয়, নামাজিরা ছুটে যায় নামাজের ঘরে । দুষ্টু খােকার সন্ধানে পল্লিমায়ের সেকি ডাকাডাকি! খোঁয়াড়ে না ফেরা ছাগলের খোঁজে বৃদ্ধা ভিটে-খােলা-পুকুর পাড় ঘুরে বেড়ায় । আয় আয় প্যাক প্যাক প্যাক আয়র বলে দিঘি থেকে হাঁসের ঝাঁক ডেকে তােলে পল্লিবধূ। ঘরে ঘরে আলাে জ্বলে ওঠে । কুপি, হারিকেন, প্রদীপের আলােয় ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠে বসে। রাতের খাবার আয়ােজন করতে গৃহিণীদের মধ্যে তাড়াহুড়া লেগে যায় । ঠাকুরমায়েরা উঠানে হােগলার পাঠি পেতে নাতি-নাতনিদের নিয়ে গল্পের আসর জমায়। বস্তুত, কুণ্ডলী পাকানাে গােয়ালের ধোঁয়া ওড়া, প্রাঙ্গণে প্রদীপ জ্বলা, সুদর্শন পােকার ওড়াউড়ি, ঝিঝির ডাক, কীটের আর্তনাদ এবং দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতাে ভারী বাতাসে আবর্তিত গ্রাম-বাংলার সন্ধ্যা স্বতন্ত্র এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয় দিন-রাত্রির সন্ধি-সঙ্গমে । সে বৈশিষ্ট্য তার একান্তই নিজস্ব, যার মধ্যে সােনার বাংলার রূপ সকরুণ মাতৃস্নেহমণ্ডিত হয়ে অনিন্দ্যসুন্দর প্রভাব বিস্তার করে; মানবজীবনে তার আবেদন যেমন ব্যাপক, তেমনিই গভীর।
সন্ধ্যার অনবদ্য রূপ : প্রকৃতিকে জ্যোতির অলংকার পরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে নিবিড় সন্ধ্যা নামে পৃথিবীতে। প্রবীণ দিনকে পিছনে ফেলে অচেনা অনবদ্য রূপে সন্ধ্যারানি এসে হাজির হয়। তবে সন্ধ্যা বড়াে চঞ্চলা, এসেই বিদায় নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ক্ষণস্থায়ী বলে তার রূপে অমন বিরহ-ব্ৰত, পবিত্র প্রেম মাধুর্য, অমন সকরুণ স্নিগ্ধতা। সন্ধ্যা ধীর পায়ে এসে চপল চরণে চলে যায় । আকুল অশ্রুসজল নয়নে সন্ধ্যাতারা তাকে বিদায় জানায়। সন্ধ্যা কোমল-গম্ভীর-স্নান-উজ্জ্বল মিশ্রিত এমন শ্রী, এমন এক পূর্ণ সৌন্দর্য ভাষায় তার চিত্রকল্প অঙ্কন সত্যিই অসাধ্য । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সন্ধ্যা বিদায়’ কবিতায় সন্ধ্যার রূপ ধরা পড়েছে। তিনি লিখেছেন-
সন্ধ্যা যায়, সন্ধ্যা ফিরে চায়, শিথিল কবরী পড়ে খুলে
যেতে যেতে কনক-আঁচল বেঁধে যায় বকুলকাননে, ...
আঁধারের ম্লান বধূয়ার বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল নয়নে।
যেতে যেতে কনক-আঁচল বেঁধে যায় বকুলকাননে, ...
আঁধারের ম্লান বধূয়ার বিষাদের বাসরশয়নে।
সন্ধ্যাতারা পিছনে দাঁড়ায়ে চেয়ে থাকে আকুল নয়নে।
ষড়ঋতুর বাংলায় সন্ধ্যা বড়াে বৈচিত্র্যময় । বর্ষার সন্ধ্যার আকর্ষণ প্রবল গভীর। প্রকৃতির সঙ্গে মানবহৃদয়ও এতে একাকার হয়ে মিশে যায়। হেমন্ত-সন্ধ্যার মােহমুগ্ধ লাবণ্যে আমাদের চোখে পলক পড়ে না। শীতের সন্ধ্যা কুয়াশার শুভ্র বসন গায়ে বিধবার মতাে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে তার মমতা আর চোখে তার করুণা ঝরে পড়ে । বসন্ত-সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাসে মন যে কেমন করে, তা কী করে বলব ...। সন্ধ্যার নির্জনতা : সন্ধ্যা শান্ত, স্তব্ধ, গম্ভীর। সন্ধ্যা ধরণিকে এক অপূর্ব মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে । চারদিকে রহস্যের ইন্দ্রজাল । অস্পষ্টতার এক পরাবাস্তব চিত্রকল্প । বুক ভরা কথা নিয়ে প্রকৃতি যেন মূক হয়ে থাকে । সারা দিনের কর্মকোলাহলের মাঝে তার যে আতিগুলাে অবহেলায় চাপা পড়ে থাকে, সে যেন তার সবটুকু এক মধুর মৌনতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন। নিস্তব্ধ নিবিড় দিগন্তহীন ঘন আঁধারে চোখ রেখে কী এক অব্যক্ত বেদনার ভাবে আমাদের হৃদয়ে সুর অনুরণিত হয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের গানের ভাষায়-
আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে।
অথচ শুনতে পাইনে কিছুই, শুধু অনুভব করি এক মৌন-মুখরতা।
অথচ শুনতে পাইনে কিছুই, শুধু অনুভব করি এক মৌন-মুখরতা।
উপসংহার : সন্ধ্যা দিবসের অবসান । ঘন আবিরের রাগে সন্ধ্যা নামে— দূর বনে কে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে । সন্ধ্যার মায়ামুগ্ধ পরিবেশ পৃথিবীর বুকে এক সুন্দরতম আবেদন জাগিয়ে তােলে । মধ্যাহ্নের কৃচ্ছতা ঘুচিয়ে ঔদার্যের ভাব নিয়ে সন্ধ্যা আসে মহাসমারােহে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় পূরবির সুর আর প্রকৃতিরাজ্যে চলে মহামিলনের এক মাঙ্গলিক মহড়া। সকরুণ সুন্দর স্নেহময়ী সন্ধ্যার আগমন তুলে ধরে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন-
সজল কাজল করুণ নয়ন অধরে মধুর হাসি
মলিন বসনা সন্ধ্যা দাঁড়ায় গগন কিনারে আসি।
মলিন বসনা সন্ধ্যা দাঁড়ায় গগন কিনারে আসি।